জহিরুল ইসলাম সোহেল: ইট পাথরের ঢাকা শহর সবুজে মাতবে আবার। ব্যাক্তি পর্যায়ে অনেকেই এখন বাড়ীর ছাদে বাগান করছেন। এর ফলে একদিকে যেমন সবুজ নির্মল পরিবেশ জায়গা করে নিচ্ছে তেমনি মিটছে বিষমুক্ত ফল সবজির নিশ্চয়তা। অন্যদিকে মনের খোরাকতো মিটছেই যার দাম অমূল্য।
মানুষের এই আগ্রহকে আরো বেশি কার্যকর ও উৎসাহ যোগাতে শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জামাল উদ্দিন এর নেতৃত্বে শুরু হয়েছে এক নতুন আন্দোলন। ভয়ের কোন কারণ নেই। কারণ, এটি কোন রাজনৈতিক আন্দোলন নয়, সামাজিক আন্দোলন। ইট পাথরের ঢাকাকে সবুজে ঢেকে দেয়ার আন্দোলন, যার নাম দেয়া হয়েছে “সবুজ ঢাকা আন্দোলন”। সম্প্রতি শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় “সবুজ ঢাকা আন্দোলন” এর এক বছর পূর্তি উৎযাপন করেছে।
ঢাকা শহরের প্রায় ১ লাখ গৃহিণীকে এ আন্দোলনের সদস্য হিসেবে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। “সবুজ ঢাকা আন্দোলন” এর উদ্দেশ্য হলো ঢাকা শহরের বেশিরভাগ বাড়ীর ছাদগুলো ইট, পাথর, বালিতে ভরা থাকে। প্লেনে কিংবা হেলিকপ্টারে উপর থেকে ঢাকা শহরের দিকে তাকালে দেখা যায়, রড-ইট-পাথরে ছাদগুলো ঢেকে আছে। জানা যায়, ঢাকার এই কলঙ্ককে সবুজ দিয়ে ঢেকে দেয়ার প্রয়াসেই তাঁরা এ আন্দোলন শুরু করেছেন। ঢাকাকে সত্যিকারের সবুজ ঢাকা হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই এই আন্দোলন।
কিন্তু এই আন্দোলনকে কিভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব? কারণ, এটা তখনই সম্ভব হবে যখন ঢাকা শহরের প্রায় সমস্ত ছাদে বাগানযোগ্য ছাদের মালিককে এই আন্দোলনের আওতায় আনা যাবে। ঢাকা শহরে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ১৭ হাজার ছাদ রয়েছে। অন্তত ৩০ হাজার ছাদকে এই আন্দোলনের আওতায় আনা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ব্যাপারটি হিসেবের খাতায় যতটা সহজ মনে হয়, বাস্তবায়ন ততটাই কঠিন। এই কঠিন কাজকে সহজ করতে এ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে দেশের স্বনামধন্য কোম্পানি এসিআই লিমিটেড। বিষয়টির যাবতীয় দিক সম্পর্কে জানতে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় এসিআই এগ্রিবিজনেস লিমিটেড -এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী ড. এফএইচ আনসারী -এর সাথে।
ড. এফএইচ আনসারী বলেন, সবুজ ঢাকা আন্দোলনের ফলে সবচেয়ে বেশি যে কাজটা হবে সেটি হলো মানুষ ঢাকাবাসী তার সন্তানদের স্বপ্ন দেখাতে পারবেন। তাহলে, প্রশ্ন আসে স্বপ্ন টা কি? ধরেন, একটা ছোট বাচ্চা ২-৩ বছর বয়স। তাকে সাথে করে নিয়ে তার বাবা বাজারে গেলেন এবং কিছু ফল কিংবা সবজির বীজ, গাছ লাগানোর পাত্র, কিছু মাটি, সার কিনলেন এবং তারপর বাসায় ফিরে আসলেন। আসার পর বাচ্চাটাকে নিয়ে তিনি ছাদে গেলেন এবং তাকে দিয়েই টবে বীজটা বপন করালেন।
৭-৮দিন পর তাকে নিয়ে তিনি আবার ছাদে গেলেন। বাচ্চাটা তখন দেখলো, সেই বীজ থেকে কিছু নতুন পাতা বের হয়েছে। তখন কিন্তু বাচ্চাটার মনের ভেতর এক ধরনের পরিবর্তন আসবে। অর্থাৎ এখান থেকেই তার স্বপ্ন দেখা শুরু হলো। সে দেখলো যে, একটা কিছু পরিবর্তন হয়েছে। গাছটা যখন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে, সবুজ পাতা গজাচ্ছে, অনেক সুন্দর আর অনেক বড় একটা গাছ হয়েছে, তখন গাছের সাথে সাথে তার মনেরও একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাবে।
এরপর সে দেখলো ঐ গাছে ফুল ধরেছে, ফল ধরেছে এবং একদিন সেই ফল তার মা সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছেন। তারপর সে ফলটা রান্না করেছে বা কাচাঁ খাচ্ছে। তাহলে ব্যাপারটা কি দাড়ালো? সে কিন্তু নিজ থেকে কিছু ভাবা বা স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেলো।
এই স্বপ্নটাই কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স¦প্ন। বর্তমানে আমাদের দেশে যেটা হয়, কিশোর বয়সের ছেলেমেয়েরা যাদের বয়স ১০-১৫ বছরের মধ্যে তারা কিন্তু পড়ালেখা, মোবাইল, কম্পিউটার নিয়েই প্রায় সময় কাটায়। তাদেরই বা কি করার আছে। বাইরে গিয়ে যে খেলবে সে জায়গাটুকুও নেই, রাস্তায় হাটার মত পরিবেশ নেই। বাধ্য হয়েই তাদের এসব নিয়ে পড়ে থাকতে হয়।
তাহলে কি করা যেতে পারে? হ্যাঁ, তাদের এই বাড়তি সময়টাতে পরিবর্তন আনার জন্যই আমাদের সবুজ ঢাকা আন্দোলন। সেটা কিভাবে? আমরা প্রত্যেক অভিভাবক যদি তাদের হাতে ছাদের এক কোনায় কিছু জায়গা দিয়ে দেই তাহলে, তারা সেখানে একটা সুন্দর ও আনন্দময় সময় কাটাতে পারবে। তখন তারা মা-বাবার কাছ থেকে পাওয়া টিফিনের টাকা থেকে কিছু সঞ্চয় করে সেও তার মা-বাবার সাথে বীজ, সার, মাটি, টব ইত্যাদি কিনে আনবে। সেগুলো নিয়ে এসে ছাদে বপন করবে এবং সেখান থেকে যখন সে ফুল ও ফল পাবে তখন কিন্তু তার মনে একটা আলাদা ভালোলাগা কাজ করবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের পরিবারে বাবা-মা, ভাইবোন থাকেন। তারা কি করবে? সারাদিন শুধু বেডে শুয়ে বা বসে থাকবে? তাদেরও তো কিছু করার থাকে বা করতে মন চায়, একটু সুন্দর সময় কাটাতে মন চায়। তারা কিন্তু এই কাজটা করতে পারে। এতে তাদের যেমন একটা সুন্দর সময় কাটবে, তেমনি মনের খোরাকও আসবে।
ড. আনসারী বলেন, আমাদের ঢাকা শহরে প্রচুর দালান-কোঠা থাকার কারণে সূর্যের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। যার কারণে ছাদ তাপমাত্রা শোষণ করে নিচ্ছে। রাতের বেলা ছাদ অতিরিক্ত গরম হচ্ছে। কিন্তু রাতের বেলায় সবাই ঠান্ডায় থাকতে চায়। যে কারণে মানুষ এসি কিনছেন, সেই এসি আবার গরম বাতাস ছাড়ছে বিপরীতে ঠান্ডা বাতাস শোষণ করে নিচ্ছে। এর ফলে আমার-আপনার সবার গরম বাতাস এক সাথে মিলিত হচ্ছে। অর্থাৎ অন্যের মতো আমিও গরম বাতাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গরম বাতাস ছাড়ছি। সবাই মিলে যখন গরম বাতাস ছাড়া শুরু করছি তখন একদিকে সূর্যের গরম বাতাস এবং অন্যদিকে মানুষের গরম বাতাস এক হচ্ছে। এজন্য দেখা যায়, ঢাকা শহরের তাপমাত্রা গ্রামের তাপমাত্রার চেয়ে ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি থাকে।
তিনি বলেন, আমরা যদি এ আন্দোলনের মাধ্যমে ঢাকার ছাদগুলোকে সবুজে ঢেকে দিতে পারি তবে ঢাকার তাপমাত্রা কমানো সম্ভব হবে। এমনকি পরিকল্পনামাফিক বাগান করতে পারলে অনেকক্ষেত্রে ঘরে এসি’র ব্যবহার কম লাগবে। এছাড়াও আপনি ঢাকা শহরকে আগের মতো সুন্দর রাখতে পারছেন। ঢাকা শহরের ময়লা আবর্জনা কমিয়ে ফেলতে পারছেন। মোট কথা, শহরকে আমরা সুন্দর আর সবুজে সবুজে ভরিয়ে দিতে পারছি।
ড. আনসারী বলেন, এখন ইস্যুটা হচ্ছে- চাইলেইতো আর এসব করা সম্ভব না। কেউ যদি এটি করতে চায় তাহলে তার একটা ছাদ লাগবে, বীজ লাগবে, গাছ লাগানোর পাত্র লাগবে, মাটি লাগবে, সার লাগবে। সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকা শহরের মানুষ এত কিছু পাবে কোথায়?
এসিআই খুব শীঘ্রই অনলাইনে এসব সুবিধাগুলো দেয়া শুরু করবে। কেউ অনলাইনে অর্ডার করলে আমরা সবকিছু তার বাসায় পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবো। কেউ চাইলে বাগান করে দিবো, চাইলে গাছ লাগিয়ে দিয়ে আসবো। কেউ চাইলে আমরা গ্রীন হাউজ করে দিবো।
এখন কথা হচ্ছে, খুব সুন্দর করে গাছগুলো লাগালাম কিন্তু গাছগুলো বেড়ে উঠার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ পেলো না। কারণ, আমাদের সবারই গ্রামের বাড়ি যেতে মন চায়। ওখানে গিয়ে ৬-৭দিন থাকতে হয়। তখন গাছগুলোকে দেখবে কে? গাছগুলোতো মরে যাবে। সেক্ষেত্রে আমরা সেখানে গভীর সেচের ব্যবস্থা করে দিবো। মোট কথা, ছাদে একটি বাগান করতে যে সমস্ত লজিস্টিক সাপোর্ট অর্থাৎ- মাটি, বীজ, চারা, আনুসঙ্গিক যন্ত্রপাতি যা যা লাগে তার পুরোটার সহায়তাই আমরা দেবো।