মো. স্বপন আহমেদ, নকলা (শেরপুর): শেরপুরের নকলায় একটি টিনের ঘরে বিদেশী মুরগি, টার্কি ও তিতির পালন করে এলাকায় ইতোমধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছেন চন্দ্রকোণা ইউনিয়নের চরমধুয়া গ্রামের মো. আবু সাদাত সোহাগ। তিনি চন্দ্রকোণা কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এনামুল হকের ছেলে। জনমুখে উপজেলার সফল খামারির উপাধি পেয়েছেন তিনি । সোহাগ তার খামার থেকে মাসে অর্ধলক্ষাধিক টাকা আয় করছেন। এই খামার দিয়েই তিনি কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। তার বিশ্বাস, এই খামারের আয়েই আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তিনি কোটিপতি হবেন। তার উৎপাদিত বাচ্চাগুলো রাজধানী ঢাকাসহ জেলা উপজেলার বিভিন্ন সৌখিন লোকদের কাছে বিক্রি করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, সোহাগের পুরাতন বাড়িতে বিদেশী মুরগি, টার্কি ও তিতির পালনের জন্য খোলামেলা জায়গা না থাকায় তিনি চন্দ্রকোণা–নারায়খোলা রাস্তার পাশে চরমধুয়া এলাকায় নতুন বাড়ি করেছেন। বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত জায়গা পরিষ্কার করে সেখানে একটি টিনের বড় ঘর তৈরী করে শুরু করেন বিদেশী মুরগি, টার্কি ও তিতির লালন পালন। শুরুতেই উৎপাদন ভালো হওয়ায় এবং এলাকা ও বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকায় প্রথম বছরেই তিনি দুই লক্ষাধিক টাকার মুরগি, টার্কি ও তিতিরের ডিম ও বাচ্চা বিক্রি করেন।
এসব গৃহপালিত পাখি পালন ঝুঁকিমুক্ত ও লাভজনক হওয়ায় ভূরদী খন্দকারপাড়া কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার বেশ কয়েকজন সদস্য তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছেন। সোহাগের দেখাদেখি জালালপুরের স্বপন আহমেদ ও টেকপাড়া খলিল, চিথলিয়ার আলম, জালালপুরের রফিজ ওকামাল, পোলাদেশীর শাহজাহাসহ অসংখ্য শিক্ষার্থী শখের বশে ওইসব বিদেশী মুরগি, টার্কি ও তিতির পালনে ঝুঁকছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আগামি বছর ছোট্ট পরিসরে হলেও খামার গড়ে তুলবেন বলে মনস্থির করেছেন।
সোহাগের লেখাপড়া শেষ হওয়ার পরে কয়েক বছর চাকরির পিছনে দৌঁড়াদৌঁড়ি করে, চাকরি না পেয়ে বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে দুই বছর কাটান। এই ফাঁকে ১৯৯৭ সালে জামালপুরের বেলটিয়া যুব উন্নয়ন কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গরুর খামার গড়ে তুলেন। কাঙ্ক্ষিত সফলতা না পেয়ে ২০০২ সালে কবুতর পালনের সিদ্ধান্ত নেন এবং এক সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহে এক নামে কবুতর খামারি হিসেবে পরিচিতি পান।
পরে এলাকার প্রায় ঘরে ঘরে কবুতর খামারি তৈরী হওয়ায় ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে সব কবুতর বিক্রি করে দিয়ে ওই খামার বন্ধ করে দেন। তারপর ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে একটি পত্রিকার প্রতিবেদন দেখে বিদেশী মুরগি, টার্কি ও তিতির পালনের সিদ্ধান্ত নেন।
সোহাগ জানান, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক জোড়া টার্কি ও ২০টি তিতির নিয়ে তার খামারের যাত্র শুরু। ছয় মাসের মাথায় ডিম দেওয়া শুরু হলে তাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তার খামারে ৭ জোড়া ডিম পাড়া বড় টার্কি, ২০ জোড়া ছোট টার্কি ও ৪২টি টার্কির ডিম; ৫৬টি ডিমপাড়া তিতির, ৭০০টি ছোট তিতির ও এক হাজার তিতিরের ডিম; এক জোড়া ডিমপাড়া বড় ফাইটার মুরগি, ৩৬টি বাচ্চা ও ৪০টি ফাইটার মুরগির ডিম এবং দুই জোড়া ডিমপাড়া ফিলব্যাগ মুরগি, ২৬টি বাচ্চা ও ১৮টি ফিলব্যাগ মুরগির ডিম রয়েছে।
প্রতি জোড়া বড় টার্কির দাম ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা, ৩০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের প্রতি জোড়া বাচ্চা ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা এবং প্রতি হালি ডিম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা; প্রতি জোড়া বড় তিতির ২হাজার ৫০০ টাকা থেকে ৩হাজার টাকা, ২৫০ থেকে ৩৫০ গ্রাম ওজনের প্রতি জোড়া বাচ্চা ৭৫০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা এবং প্রতি হালি ডিম ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা করে বিক্রি করেন; তাছাড়া ফাইটার ও ফিলব্যাগ মুরগির ২৫০ থেকে ৩৫০ গ্রাম ওজনের প্রতিটি বাচ্চা ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা এবং প্রতিটি ডিম ৪০০ টাকা করে বিক্রি করেন বলে জানান তিনি।
বছরে টার্কি ও বিদেশী মুরগি ৮৫ থেকে ১১০ টি ডিম এবং তিতির ১২০ থেকে ১৩৫টি ডিম দিয়ে থাকে। তার দেওয়া হিসাবমতে, ২০১৪ সালের জুলাই হতে এ পর্যন্ত তিনি কমপক্ষে অর্ধকোটি টাকা আয় করেছেন। তার খামারে প্রতি মাসে সর্বসাকুল্যে ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা ব্যয় করে, আয় করেন লক্ষাধিক টাকা।
তিনি আরো জানান, খামার ব্যবসার পাশাপাশি নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ওয়ার্ডার পেয়ে দুই এক মাস অন্তর অন্তত একটি করে ডিম ফোটানোর ইনকিউবেটর তৈরী করেন তিনি। প্রতিটি ইনকিউবেটর তৈরীতে ব্যয় হয় ৪০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার টাকা, বিক্রি করেন ৬০ হাজার টাকা থেকে ৬৫ হাজার টাকা করে। তাতে প্রতিটি ইনকিউবেটরে লাভ থাকে প্রায় ২০ হাজার টাকা।
জানা যায়, টার্কি ও তিতিরকে ৭০ ভাগ তৃণ জাতীয় কচি ঘাস ও ৩০ ভাগ বাজারের দানাদার খাবার এবং বিদেশী মুরগিকে গম, ভূট্টা, ছোলা ভাঙ্গাসহ বাজারের দানাদার খাবার বেশি দিতে হয়।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. আবুল খায়ের মোহাম্মদ আনিছুর রহমান বলেন, যে কেউ টার্কি, তিতির ও বিদেশী মুরগি পালন করে স্বাবলম্বী হতে পারেন। এ ব্যাপারে প্রাণিসম্পদ বিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সহজ ব্যাংক ঋণ, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও সার্বিক সহযোগিতাসহ সার্বক্ষণিক পরামর্শ সেবা পেলে ওইসব প্রাণির খামারের মাধ্যমে বেকারত্বকে দূরে ঠেলে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব বলে মনে করছেন সুধীজন।