শুক্রবার , নভেম্বর ২২ ২০২৪

মরণঘাতি ক্যান্সার থামাতে পারেনি উদ্যোক্তা সুমনাকে

মো. খোরশেদ আলম জুয়েল : জীবন স্রোতের মতো বহমান। নদীর পানিতে যেমন ঢেউ লাগে জীবনের গতিতেও ঢেউ আছে, রয়েছে ছন্দপতন। তবে নদীর ঢেউ আর জীবনের ছন্দপতন -এ দুটো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য হলো জীবনের ঢেউ সবাই সামাল দিতে পারেনা। কেউ সাহসের সাথে লড়াই করে টিকে যান, কেউবা ছিটকে পড়েন। সাহস করে, লড়াই করে টিকে যাওয়া তেমনই একটি নাম রোকেয়া পারভীন সুমনা। ফ্যাশন হাউজ বৈচিত্র্য’র স্বত্বাধিকারী। একের পর এক উত্থান পতনের মাঝেও নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টায় এই সাহসী উদ্যোক্তা। আর্থিক কস্ট থেকে ক্যান্সারের মতো মরনঘ্যাতি কোনকিছুই দমাতে পারেনি তাঁকে।

স্বামী ও একমাত্র মেয়ের সাথে সুমনা

সুমনা ছোট বেলা থেকেই মেধাবী ও সৃজনশীল। সৃজনশীলতা কিংবা নিত্য নতুন উদ্ভাবনী জ্ঞান যাই বলা হোক না কেন এটা সম্ভবত উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছেন তিনি। আঁকা-আকি আর সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি আগ্রহ ছিল সুমনার শৈশব থেকেই। ভিন্নধর্মী ও বৈচিত্র্যময় চিন্তা নিয়েই বড় হয়েছেন। বাবা লুৎফুল বারী আঁকতেন খুব সুন্দর ছবি, মা মা- লায়লা বারী গাইতেন গান। সুমনার সংগ্রাম মূলত ২০০২ সনে বাবা মারা পর থেকেই শুরু। ২০০৪ সনে এসএসসি দেয়ার কথা থাকলেও বাবা মারা যাওয়ার কারণে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৫ সনে এসএসসি পাশ করেন। ২০০৭ সনে বাংলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করার পরপরই বিয়ে যায়। স্বামীর নাম মাকসুদুর রহমান মুহিম পেশায় ব্যবসায়ী। স্বামীর সহযোগিতায় বিয়ের পরেও অনার্স পড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন সেই সাথে ইন্টেরিয়ার ডিজাইন -এর ওপর ডিপ্লোমা কোর্স। ২০১১ সনে সুমনা-মাহিমের সংসার আলো করে আসে কন্যাসন্তান সারিয়া রহমান আহির।

ছোটবেলা থেকেই সুমনার স্বপ্ন ছিল নিজে স্বতন্ত্র কিছু করার। নানা ঘাত প্রতিঘাত তাকে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নকে জোড়ালো করে। সুমনা উপলব্ধি করতে থাকেন- শুধু কি গাছপালার মত বেঁচে থাকা, সিংহের মতো খাদ্য খুঁজে বেরানো কিংবা মাছের মত ডিম পাড়া -এটাই কি মেয়েদের কাজ? তার মনে প্রশ্ন জাগে, আমাদের পরিচয় আসলে কী? কখনো বাবার পরিচয়, কখনো বরের পরিচয়, কখনো ছেলের পরিচয়…. এতো ভিড়ের মাঝে আমার পরিচয় তাহলে কোথায়?

এই পরিচয় খুজতেই ২০০৯ সনে ঘরের ভেতরে ছোট্ট পরিসরে শুরু করেন বৈচিত্র্যময় চিন্তার সৃষ্টিশীল প্রতিষ্ঠান ‘বৈচিত্র্য’। ঘর সংসারের পাশাপাশি প্রথমে বিভিন্ন ধরনের শালোয়ার কামিজ, শাড়ী, ব্লক বাটিক করতেন। এসব বিক্রি করতেন পরিচিত এবং আত্মীয় স্বজনের মাঝে। এভাবে ভালোই চলছিল সুমনার। হঠাৎ করে ব্যবসায়ী স্বামী ব্যবসাতে মারাত্মক মন্দা চলে আসে। সংসারে অভাব অন্যদিকে আত্মীয় স্বজনের কাছে ধারদেনা করারও পক্ষপাতী নন সুমনা। বাধ্য হয়ে চাকুরি শুরু করেন কিছুদিন। এর মাঝে হঠাৎ করেই মেয়ে আহির অসুস্থ হয়। এবার তিনি চাকুরি ছাড়তে বাধ্য হলেন।

একদিকে মেয়ের অসুস্থতা এবং অন্যদিকে পুরো সংসার এর মাঝে ২০১২ সন থেকে শরীরে বিভিন্ন সময়ে অসুস্থতা বোধ করতে থাকেন। ফলে ভাটা পড়তে থাকে বৈচিত্র -এর কাজে। এভাবেই চলছিল কোনমতে। তবে সামনে যে, আরো ভয়াবহ দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে সুমনা হয়তো নিজেই ভাবেননি। ২০১৩ সনে তার শরীরে ধরা পড়লো মরনঘাতী ক্যান্সার। এরপর পুরোপুরি বিছানায় পরে যান তিনি, কারো সহায়তা ছাড়া বিছানা থেকে উঠতে পারতেননা। বন্ধ হয়ে যায় সব কাজ।

সুমনার ভাষ্যমতে- আল্লাহর রহমত যে, একদম প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার ধরা পরে। তবে যে সাপের ছোবল খাইনি সে বুঝবে না সাপের বিষে কি জ্বালা। ক্যান্সারটাও তাই। কেউ একটু স্পর্শ করলেই ব্যাথায় কুকড়ে যেতাম। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে লড়ে যাচ্ছিলাম সারাক্ষণ। তবে আমার মনের জোর অনেক বেশি। আমাকে সবসময় সাহস-সঙ্গ-প্রেরণা দিয়েছে আমার স্বামী, পরিবার, বন্ধুবান্ধব। আমার খুব প্রিয় ছিলো চুল। ক্যান্সারের জন্য যেদিন চুল ফেলে দিতে হয় সেদিন মনে হচ্ছিললো আমি হেরে গেলাম। কিন্তু পরক্ষণেই মনকে বুঝালাম, দিলাম সাহস।

সুমনা বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রতিজ্ঞা করলেন, যে সিড়িতে উঠা শুরু করেছি সেটি থেমে যাওয়ার জন্য নয়, থেমে থাকবোনা। ২০১৪ সনে সামান্য কিছু টাকা নিয়ে বৈচিত্র্যের কাজা শুরু হয় আবারো। তৈরি করতে থাকলেন ফেলে দেয়া জিনিস দিয়ে নতুন নতুন ক্রাফট, গহনা ,কার্ড , গ্লাস পেইন্ট, গঈখ দিয়ে আর্ট, ক্লে কাজ, ব্লক, বাটিক, এপ্টিক এবং পাট ও লেদার নিয়ে কাজ। বৈচিত্র্য নামে ফেসবুক পেইজ খোলেন। ভিন্নধর্মী, আকর্ষণীয় ডিজাইন ও দেশীয় ম্যাটেরিয়াল ব্যবহারের কারণে ক্রেতারা সহজেই আকৃষ্ট হন। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে সুমনার তৈরি জিনিসের চাহিদা। তিনি সব সময় মাথায় রাখেন, কিভাবে দেশি জিনিস নিয়ে কাজ করা যায়।

ইদানিং সবচেয়ে বেশি আগ্রহ তার পাটের তৈরি পণ্য তৈরিতে। সোনালী আঁশের পণ্য তৈরি ও বিক্রির মাধ্যমে গড়তে চান নিজের সোনালী দিন। সুমনা জানান, পাটের বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্যের চাহিদা দিনকে দিন বাড়ছে। আমাদের অনেকের ধারনা নেই, পাট দিয়ে কত সুন্দর ও স্পেশাল জিনিস হতে পারে। পাট দিয়ে আমরা বিভিন্ন ধরনের গহনা, জামা, ব্যাগ তৈরি করে থাকি। বিশেষ করে পাটের তৈরি ব্যাগের চাহিদা প্রচুর। আমরা অনেক সময় সাপ্লাই দিয়ে কুলোতে পারিনা।

বৈচিত্র্য এর তৈরি পণ্যগুলোর মধ্যে ব্যাগ, টুপি, ফটোফ্রেম, চাবির রিং, মোবাইল কাভার, মানিব্যাগ, টেবিল ম্যাট, পাটের বাটুয়া, পাটের গহনা, লেদারের ছোট ছোট ব্যাগ, মানি ব্যাগ, চাবির রিং, ফটোফ্রেম, মোবাইল কাভার, লেদারের গহন, কাপড়ের ব্যাগ-গহনা, সুতার গহনা, জামদানি র গহনা, জামদানির ব্যাগ, কাগজের গহনা, প্লাস্টিক বোতলের গহনা, প্লাস্টিক বোতলের বক্স ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

আগে যেখানে সুমনা একাই কাজ করতেন সেখানে যোগ হয়েছে ৫ জন কর্মচারী। তিনি তাদেরকে ধরাবাধা কর্মচারির মতো দেখেন না। তার উদ্দেশ্য যেহেতু নিজের এবং পাশাপাশি সমাজের অবহেলিত নারীদের প্রতিষ্ঠা তাই তিনি তাদের কাজের জন্য আলাদা একটা সময় বের করে দিয়েছেন। কারো সংসারের এবং সন্তানের লেখাপড়ায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য বিকেল ৩টা থেকে ৭টা পর্যন্ত সময়টাকে তিনি কাজের সময় হিসেবে বেঁছে নিয়েছেন। কারো সুবিধা অসুবিধা এবং পণ্যের অর্ডার অনুযায়ী এ সময় কম বেশি হয়।

ইতোমধ্যে বৈচিত্র্য এর পণ্যের অর্ডার বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন শো-রুম থেকে বাসায় এসে পণ্য নিয়ে যান। ফেসবুক পেইজের মাধ্যমেও আসছে প্রতিনিয়ত অর্ডার। আগামী ফেব্রুয়ারিতে ভারতের কলকাতার একটি মেলায় প্রদর্শিত হবে তার তৈরি পণ্য। তার ইচ্ছা আছে বৈচিত্র্যকে আস্তে আস্তে বট বৃক্ষে পরিণত করা। এছাড়াও ওয়ার্কশপ ট্রেনিং এর মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিত নারীদের কাজ শেখাতে চান তিনি। যাতে সুবিধাবঞ্চিত নারীরা নিজেদের পরিচয়টাকে তাদের সামনে তুলে ধরা। দেশীয় ফ্যাশনকে আন্তর্জাতিকভাবে সবার সামনে তুলে ধরার ইচ্ছে আছে।

সুমনা বলেন, পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষ কিছু সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। নিজের মেধা আগ্রহ কঠোর পরিশ্রম এবং চারপাশের পরিবেশ থেকে পাওয়া সুযোগ সুবিধার সঙ্গে সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হয়। যদিও চলার পথে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাই সমাজের বিচারের সফল কিন্তু জীবনে এত বাঁধার পর বারবার এগিয়ে যাওয়াকেই আমি সফলতা হিসেবে গণ্য করি। তাই আমি আমার বৈচিত্র্য ভুবনে সফল।

This post has already been read 7778 times!

Check Also

ইটভাটাতে বিদেশি ফলের বাগান গড়ে আলোচিত চাঁদপুরের হেলাল উদ্দিন

মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর প্রতিনিধি) : চাঁদপুর শহরতলীর শাহতলী গ্রামে নিজেদের ৬০ বছরের লাভজনক ইটভাটা ছেড়ে …