ড. মোহাম্মদ মাইনউদ্দিন মোল্লা : লিচু অবউষ্ণমন্ডলীয় ফল। একটি অন্যতম সুস্বাদু ফল হিসেবে বাংলাদেশের সকল শ্রেণির লোকের কাছেই এটা অত্যন্ত প্রিয়। মাঠ পর্যায়ে লিচুর নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে গবেষণা অব্যাহত থাকলেও এর রং ধরে রাখা এবং সংরক্ষণকাল তথা জীবনীশক্তি বাড়ানোর ওপর তেমন কোন গবেষণা ও এর প্রয়োগ বাংলাদেশে তেমন পরিলক্ষিত হয়নি। বাস্তবচিত্রে দেখা যায় যে, লিচুর সংরক্ষণকাল খুব কম হওয়ায় বাজারে বেশী দিন এটা পাওয়া যায় না। তাছাড়া এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হল খোসা তাড়াতাড়ি বাদামী বর্ণ ধারণ করে। উন্মুক্ত অবস্থায় ২০-৩০০ সে. তাপমাত্রায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর খোসা বাদামী বর্ণ হয়ে যায় যা এর বাজারমূল্য তথা ভোক্তার পছন্দের উপর প্রভাব পরে। উ
ন্নত বিশ্বে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এর Peri-carp browning এবং সংরক্ষণকাল বৃদ্ধির উপর গবেষণা হয়েছে কিন্তু সহজ পদ্ধতিতে সস্তা ও সুলভ প্যাকেজিং ম্যাটেরিয়েল ব্যবহার করে এর রং ধরে রাখা এবং সংরক্ষণকাল তথা জীবনীশক্তি বৃদ্ধির এই প্রয়াসই প্রথম।
কিন্তু আমাদের দেশের উৎপাদকরা ফলের সর্টিং এবং গ্রেডিং না ক
রে বাজারজাত করেন। সাধারণত ৫০টি লিচু দিয়ে এবটি বান্ডেল তৈরী করা হয় এবং বাজারজাতকরণের জন্য লিচু বাঁশের টুকরীতে ভরে চারদিক পাতা দিয়ে ভালোভাবে ঢেকে দেয়া হয়। আবার কখনো কখনো ফল বাঁশের ঝুড়িতে ভরে চটের বস্তা দিয়ে চারদিক মুড়িয়ে দেয় হয় (চিত্র-১)। এ দুটি কাজের উদ্দেশ্য ফলকে বাহিরের আঘাত থেকে রক্ষার পাশাপাশি বাতাসের সংস্পর্শে আসতে না দেয়া। কারণ, বাতাসের সংস্পর্শে এলে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে ফলটির বাহিরের অংশ কালচে রং ধারণ করার পাশাপাশি ভক্ষণীয় অংশ বাদামী বর্ণ ধারণ করে। যাইহোক, এ দুটি প্রচলিত প্রক্রিয়ায় লিচুর রং ২-৩ দিনের বেশী ধরে রাখা যায় না।
লিচুর সহজ ও উন্নত সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনা
সংগ্রহ : গাছ থেকে লিচু সংগ্রহের সময় রশি ও বাঁশের তৈরী ঝুড়ি/টুকরী নিয়ে গাছে উঠতে হবে। কিছু পাতা ও ছোট ছোট ডালসহ ভেঙ্গে টুকরীতে ভরতে হবে। টুকরী লিচুতে পরিপূর্ণ হলে রশি দিয়ে বেঁধে টুকরীটি আস্তে করে গাছের উপর থেকে মাটিতে ছেড়ে দিতে হবে। এ কাজটি করার সময় অন্য একজন গাছের নিচে থেকে বাঁশের ঝুড়িটি ধরতে পারেন।এভাবে সংগ্রহ করলে সংগ্রহকালীন লিচুর ক্ষতির পরিমাণ কমানো যাবে।
প্রাক-শীতলীকরণ : গাছ থেকে লিচু সংগ্রহের সাথে সাথে যত দ্রুত সম্ভব ছায়াযুক্ত স্থানে রাখতে হবে। ছায়াযুক্ত স্থান হিসাবে গাছের তলা বা বাড়ির বারান্দা বা তাবু টানিয়ে নিতে হবে। মাঠ বা উৎপাদন স্থান থেকে প্যাকিং হাউজে স্থানান্তরের পর বা বাজারজাতকরণের পূর্বে প্রাক-শীতলীকরণ করতে হবে।
ছাঁটাইকরণ ও বাছাইকরণ: লিচু সংগ্রহের পর পর অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ও পাতা ফেলে দিতে হবে। রোগ ও পোকামাকড় আক্রান্ত, ফাঁটা এবং রোদেপোড়া
লিচুগুলো ভালো লিচু থেকে বেছে ফেলে দিতে হবে। আকার-আকৃতিতে তুলনামূলকভাবে ছোট ও অপরিপক্ব বা পরিপূর্ণ রং ধারণ করেনি এমন লিচুগুলোকেও ভালো লিচুগুলো থেকে বেছে ফেলে দিতে হবে (চিত্র-২)। এতে লিচুর সংগ্রহোত্তর কাল বৃদ্ধির পাশাপাশি ক্রেতার আকর্ষণও বৃদ্ধি পাবে।
ধৌতকরণ: লিচু পানি দিয়ে ধৌত করলে গায়ে লেগে থাকা পানি শুকানোর সাথে সাথে প্যাকিং ও সংরক্ষণ না করলে কালচে রং ধারণ করে। কাজেই লিচুর বেলায় ধৌতকরণ এড়িয়ে যেতে হবে। সম্প্রতি Chitosan নামক ক্যামিক্যাল দিয়ে ফলের সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি করার তথ্য থাকলেও লিচুর বেলায় তা ব্যাতিক্রম। সম্প্রতি এর উপর আমাদের গবেষণায় দেখা যায় যে, লিচুর খোসা (চববষ) ডটেড হওয়ায় Chitosan এর গায়ে লেগে থাকে এবং সাদা পাউডারের মত স্পষ্ট আবরণ প্রতীয়মান হয় (চিত্র-৩) যা ক্রেতা বা ভোক্তার আকর্ষণ কমিয়ে দেয়।
লিচুর রং -এর উপর প্যাকিং ও সংরক্ষণ পদ্ধতির প্রভাব : বাদামী বর্ণের কাগজ (ব্রাউনিং পেপার) (০.০৬ মিমি পুরুত্ব) দিয়ে মুড়ি
য়ে লিচুগুলো অছিদ্রযুক্ত পলিথিন ব্যাগে (Non- Perforated polyethylene bag) ভরে সংরক্ষণ করতে হবে (চিত্র-৪)। ব্যাগিং এর সময় পলিথিন ব্যাগের মুখ শক্ত সুতা বা সুতলি দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। তারপর প্যাকেটজাতকৃত লিচুগুলোকে ৫±১ডিগ্রী সে.গ্রে. তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে।
এভাবে সংরক্ষণকাল ৩০ দিনের বেশী বৃদ্ধি করা যায়। নিম্ন তাপমাত্রায় (৫±১ ডিগ্রী সে. গ্রে.) সংরক্ষণকালীন বাদামী বর্ণের কাগজটি প্রতি ২ সাপ্তাহ অন্তর অন্তর পরিবর্তন করলে এর সংরক্ষণকাল ৪০ দিনেরও বেশি বৃদ্ধি করা যাবে (চিত্র-৫)। তাছাড়া এ সহজ পদ্ধতিটি ব্যবহারের মাধ্যমে ১৫-১৬% ওজন হ্রাস এবং ২৫-২৬% খারাপ হওয়া কমানো যাবে।
লেখক: গবেষক, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি), আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, আকবরপুর, মৌলভীবাজার।