ফকির শহিদুল ইসলাম(খুলনা): খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশিতে শাকবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। আইলায় ভেঙ্গে যাওয়া হারেস খালীর ৩০০ গজ দুরে জোড়সিং বাজার লঞ্চঘাট শাকবাড়ীয়া নদীতে বিলীন হওয়ায় সমগ্র দক্ষিণ বেদকাশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। বাঁধ মেরামতে গত তিন দিনেও সরকারিভাবে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। এদিকে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই নদী ভাঙ্গন শুরু হওয়ায় গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলজুড়ে আতংক দেখা দিয়েছে। খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের ২ হাজার ২৯২ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ৪২৪ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। এসব উপকূলের হাজার হাজার বাসিন্দারা উত্তাল নদী, আকাশে মেঘ আর আবহাওয়া বৈরী হলেই ভয়ে আঁতকে উঠে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, পাউবোর খুলনা-১ এর অধীনে ৩৬৫ দশমিক ২৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। সংস্কারের অভাবে অন্তত ১০৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের অবস্থা জরাজীর্ণ। পাউবো খুলনা-২ এর অধীনে ৫১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৪৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ।
একই অবস্থা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায়। বাগেরহাটের ৩১৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে প্রায় ৬০ কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এছাড়া প্রায় ৪০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ নিচু হয়ে গেছে। ভরা জোয়ারের সময় বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্র জানায়, জেলার ৭৯৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ২১০কিলোমিটার বেড়িবাঁধই ঝুঁকিপূর্ণ। দ্রুত সংস্কার করা না হলে আসন্ন দুর্যোগ মৌসুমে এসব বেড়িবাঁধ ভেঙে প্লাবিত হতে পারে বিশাল এলাকা। দেখা দিতে পারে মারাত্মক বিপর্যয়।
কয়রার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের গোলখালী গ্রামের মো. তসলিম মোল্লা বলেন, ‘বসবাস করি খুলনা জেলার মধ্যে, কিন্তু আমাদের বেড়িবাঁধ সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায়। সঙ্গত, কারণে তারা আমাদের বেড়িবাঁধ সংস্কারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় না। দীর্ঘদিন জরাজীর্ণ ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে একটু সংস্কার করেছি। যে কোন মুহূর্তে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নটি, মানচিত্র থেকে মুছে যেতে বসেছে পাউবো’র অবহেলায়!
কয়রা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আ খ ম তমিজ উদ্দিন বলেন, উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টি ইউনিয়ন নদী ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা মো. মসিউল আলমের জানান, ‘পাউবো-১ এর আওতায় ৩৭৭ দশমিক ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৬০ কিলোমিটার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা এরই মধ্যে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে নোটশিট পাঠিয়েছি। কিন্তু আপাতত কোন বরাদ্দ নেই। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী অপূর্ব কুমার ভৌমিক বলেন, পাউবো-২ এর ৪২২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ১৫০ কিলোমিটার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। নোটশিট পেশ করার পর গতবছর ২ কোটি ২৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এই অর্থে মাত্র ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরে প্রাণ হারায় উপকূলের অন্তত সাত হাজার বাসিন্দা। ২০০৯ সালে ২৫ মে আইলা আঘাত হেনে ছিল উপকূলে। ১৯৮৮ সালের ২৯ নভেম্বরের বন্যা, ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের জলোচ্ছাসসের দুর্বিসহ স্মৃতিতে এখনো শিউরে উঠেন প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্ষতিগ্রস্তরা। উপকূলীয় সমস্যা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সিডিপি’র খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী এস এম ইকবাল হোসেন বিপ্লব বলেন, অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ আর সূইচগেট। চিংড়ির ঘেরে লবণ পানি তোলার ওই সূইচগেটগুলো উপকূলের জন্য মরণ ফাঁদ। নদী খাল ভরাট হয়েছে, ফলে জলোচ্ছাস হলেই উপকূলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে। তাছাড়া যুগের পর যুগ বেড়িবাঁধগুলোর যথাযথভাবে সংস্কার না করে, যেনতেনভাবেই দায় সারছে কর্তৃপক্ষ। তাই উপকূলে বাঁধের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।
পাউবো খুলনা-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শরিফুল ইসলাম বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের বর্ণনা ও সংস্কার ব্যয় সম্পর্কে মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র প্রেরণ করেছি। তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলো মেরামতে কাজ করা হচ্ছে। প্রাপ্ত অর্থের ভিত্তিতে কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়াও ৩২ ও ৩৩ নং পোল্ডারটির ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলোর মেরামতে বিশ্বব্যাংকের সাথে চুক্তি হয়েছে। এজন্য পাউবো আর নতুন করে কাজ শুরু করেনি। সেগুলোর কাজও চলমান রয়েছে।
এদিকে গত শুক্রবার মধ্যরাতে হারেস খালীর ৩০০ গজ দুরে জোড়সিং বাজার লঞ্চঘাট শাকবাড়ীয়া নদীতে বিলীন হয়। বাঁধ মেরামতে গত তিন দিনেও সরকারি ভাবে কোন উদ্যাগ গ্রহণ করা হয়নি। রোববার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কবি শামছুর রহমান ও কয়েকজন ইউপি সদস্য ৫০/৬০ জন লোক নিয়ে ডাল-পালা ও ইট বস্তায় ভর্তি করে ইটভর্তি বস্তা ও ডাল-পালায় বেঁধে ভাঙ্গন কবলিত নদী গর্ভে ফেলা হচ্ছে। শুক্রবার সকাল ৭ টায় নদীতে ভাটার সময় জোড়সিং বাজারের ৮ টি দোকান সহ লঞ্চঘাটের পল্টন ও সিড়ি আকস্মিক ভাবে নদী গর্ভে ঢসে পড়ে। ঘটনার কয়েক মিনিটের মধ্যে লঞ্চঘাটের পল্টন নদীর মধ্যে চলে যায় এবং দোকানঘর গুলো নদীতে ভাসতে থাকে। তবে মানুষের কোন ক্ষতি হয়নি বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য ২০০৯ সালের ২৫ মে উক্ত জোড়সিং বাজারের ৫০০ গজ পশ্চিম শাকবাড়ীয়া নদীর বেড়ীবাঁধ ভেঙে ২৪ ঘন্টার মধ্যে হারেস খালী নদীতে পরিণত হয় এবং দীর্ঘ ৩ বছর পর সেখানে বাঁধ নির্মাণ করা হয়। বর্তমান হারেস খালী থেকে ৩০০ গজ পূর্বে জোড়সিং বাজার লঞ্চঘাট ও একটি সুইজ গেট যা সম্পূর্ণ এখন নদী গর্ভে। রোববার সকালে ঘটনাস্থলে দেখা যায় বিধ্বস্ত জোড়সিং বাজারের দু’পাশে এবং বেঁড়ীবাঁধের ভিতরে একাধিক স্থানে নতুন করে ফাটল দেখা দিয়েছে। এলাকাবাসীর ধারণা উক্ত ফাটল এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সমগ্র দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ৩২ হাজার জনগণ। ফলে সমগ্র ইউনিয়নবাসী পবিত্র রমজান মাসের শুরুতেই রাতের ঘুমকে হারাম করে আতঙ্কের মধ্যে দিনতিপিাত করতে হচ্ছে। এলাকাবাসীর মতে ফাটল এলাকা নদী গর্ভে বিধ্বস্ত হলে হারেস খালীর চেয়ে বড় কিছু হতে পারে এই ইউনিয়নে।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কবি শামছুর রহমানের সাথে কথা বললে তিনি অত্যান্ত দুঃখের সাথে কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন গত ৩ দিনে স্থানীয় সাংসদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান সহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক কর্মকর্তার কাছে সাহায্যের জন্য কাকুতি মিনতি করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি। যে কারনে তিনি রোববার সকাল থেকে এলাকার কিছু লোকজন এবং তার মেম্বরদের নিয়ে সেচ্ছাশ্রমে কাজ করছেন। তিনি বলেন যে ভাবে নতুন করে ফাটল দেখা দিয়েছে তাতে জোড়সিং বাজারে সাইক্লোন সেল্টার ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ ২৫/৩০টি বাড়ীঘর যে কোন মুহুর্তে নদী গর্ভে বিধ্বস্ত হতে পারে। তিনি আরও বলেন সরকারি এবং উপজেলা পরিষদের ও ওয়াপদা কতৃপক্ষের সহযোগিতা না পেয়ে আল্লাহর উপর নির্ভর করে এই বেঁড়ীবাঁধের উপরে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের নিয়ে সর্বক্ষণ পর্যবেক্ষণ করছি। তবে পানি উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. মসিউল আলম বলেন তিনি শনিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নিতে উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে জানিয়েছেন।