মো. খোরশেদ আলম (জুয়েল) : অপরিকল্পিত নেতিবাচক জেদ মানুষকে যেমন ধ্বংস করতে পারে, তেমনি পরিকল্পিত গঠনমূলক জেদ মানুষকে সাফল্যের চূড়ায় আরোহন করাতে পারেন। এ কথা সত্য, জেদের সাথে যদি সঠিক পরিকল্পনা, শ্রম ও সততা থাকে সৃষ্টিকর্তাও তার পাশে থাকেন। অন্যের অবহেলাকে গঠনমূলক জেদ হিসেবে যদি কেউ কাজে লাগাতে পারে তবে তার জয় সুনিশ্চিত। আজকে এমনই এক জীবন জয়ী মানুষের গল্প শুনাবো যিনি কঠোর পরিশ্রম, সততা ও জেদের মাধ্যমে নিজে যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তেমনি প্রতিষ্ঠিত করেছেন পরিবারের সদস্যদের। নিজ ও আশেপাশের এলাকার মানুষের কাছে অধিষ্ঠিত হয়েছেন আইডল হিসেবে।
বলছিলাম ঢাকা জেলার কেরাণীগঞ্জ উপজেলার কাঠালতলী গ্রামের মো. মজিবর রহমানের কথা। কিছুদিন আগে নিজেদের একটি কৃষিজমি দেখতে গিয়েছিলাম গ্রামটিতে। জাতীয় সংসদ ভবন থেকে ছয়-সাত কিলো পশ্চিমে অবস্থিত গ্রামটির অধিকাংশ মানুষই প্রবাসী এবং কৃষিজীবী। আমাদের জমির পাশেই মেঠোপথ ধরে বাইক নিয়ে খুব আস্তে আস্তে এগুচ্ছিলাম। হঠাৎ একটি পিকআপ ভ্যান চোখে পড়লো যেটিতে কয়েকজন লোকজন ঘাস কেটে এনে লোড করছিলেন। হাল্কা পাতলা গড়নের ময়লা জামার একজন লোক বসে আছেন পিকআপ ভ্যানের ড্রাইভিং সিটে। কৌতুলবশতঃ জিজ্ঞেস করলাম,
এখানে কোন গরুর খামার আছে?
উত্তরে বললেন – হ।
খামারের মালিক কে ভাই?
এবার উত্তর দিলেন-আমার!
আরো কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে খুব আগ্রহ হলো লোকটি সম্পর্কে। জানতে চাইলাম তার খামার সম্পর্কে, শুনতে চাইলাম তার জীবনের কাহিনী। আসুন তাহলে শুনি সেই কাহিনী।
আজ থেকে প্রায় বত্রিশ বছর আগের কথা। মজিবরের গ্রামের যুবক ও সমবয়সীরা অনেকেই জীবীকার সন্ধানে বিদেশ পাড়ি দিচ্ছেন। কেউ ইতালি, কেউ কুয়েত কিংবা সৌদি। কিশোর মজিবরের বয়স তখন কত হবে পনেরো কি ষোল। সমবয়সী অনেকেই বিদেশ যাচ্ছে এবং ভালোই ইনকামপাতি করছে শুনে তারও ইচ্ছে হলো বিদেশ যাবেন। সিদ্ধান্ত নিলেন সৌদি আরব যাবেন।
মজিবরের পিতা মো. বিল্লাল মিয়া গোয়ালের কাজ করেন। মা ফজিলত বেগম গৃহিনী। তিন ছেলে ও দুই মেয়ের অভাবের সংসার। জমিসম্পদও নেই তেমন একটা যে কিছু বিক্রি করে ছেলেকে সেখানে পাঠাবেন। সৌদি আরব যেতে তখন হাজার ত্রিশেক টাকা লাগাতো। ছেলে মজিবরকে বিদেশ পাঠানোর জন্য বিল্লাল মিয়া কোনমতে বিশ হাজার টাকা যোগার করলেন। কিন্তু আরো যে লাগবে দশ হাজার টাকা। বাকী টাকা এখন কোথায় পাবেন? চিন্তা পড়ে গেলেন মজিবর ও তার বাবা। ছুটে গেলেন পাশের গ্রামেরই মাতাব্বর টাইপের স্বচ্ছল এক লোকের কাছে ঋণের জন্য। লোকটি সব শুনে বললেন, তোমাদেরতো কিছু নাই, জায়গা জমিও নাই। যদি তোমার ছেলে বিদেশ যেতে না পারে তবে ঋণের টাকা ফেরত দিবে কীভাবে? সুতরাং তোমাদের টাকা ঋণ দেয়া যাবেনা।
কী আর করা, ভঙ্গুর মন নিয়ে বাসায় ফিরে আসলেন বাপ-ছেলে। ঘটনাটি মজিবরের মনের ভেতর একটা দাগ কেটে গেল। কিন্তু মজিবর হঠাৎ করে নিজের ভেতরে এক ধরনের শক্তি অনুভব করলেন। শক্তিটির নাম আত্মবিশ্বাস। মনে মনে জেদ করলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন বিদেশ যাবোনা, দেশেই কিছু করবো। সিদ্ধান্ত মোতাবেক বাবার মতোই গোয়ালার কাজ শুরু করলেন মজিবর। আশেপাশের গ্রাম থেকে দুধ দোহন করে সেগুলো শহরে এনে বিক্রি করতে লাগলেন। সংসারের খরচ বাদেও কিছু টাকা সঞ্চয় করতে লাগলেন। এভাবেই চলছিল।
একদিন পাশের গ্রামের এক মহিলা তার কাছে থাকা একটি দেশি গরু বিক্রি করে দেবেন বলে জানালেন মজিবরের বাবাকে। দাম ছয় হাজার টাকা। মজিবরের বাবার কাছে তখন সে গরু কেনার মতো টাকাও নেই। অন্যদিকে ভদ্র মহিলার স্বামী নেই, গরু লালন পালন করারও কেউ নেই। আশংকা করছিলেন গরুটি বাড়ীতে থাকলে বরং ভাইয়েরা সেটি বিক্রি করে দিতে পারে। তিনি বললেন, আপনাকে সব টাকা একসাথে দিতে হবেনা। সময় সুযোগমতো আস্তে আস্তে পরিশোধ করলেই চলেবে।
এবার মজিবরের নিজের একটি গরু হলো। সেটিকে লালন পালনের পাশাপাশি গোয়ালের কাজও করছিলেন। আশেপাশের গ্রাম থেকে সংগ্রহ করা ও নিজের গাভীর দুধ ঢাকা শহরে এসে বিক্রি করতে লাগলেন। আস্তে আস্তে টাকা জমতে থাকলো, কিনলেন আরো একটি অস্ট্রেলিয়ান জাতের গাভী। গরুর বাচ্চা হওয়ার পর আস্তে আস্তে বেড়েছে দুধ উৎপাদন ও গরুর সংখ্যা। দুধের গাভী বিক্রি করে ষাঁড়গুলো বিক্রি করে দিতেন কোরবানীর ঈদে। ঘড়ে বৃদ্ধ মা-বাবা এবং সাথে আছেন দুই ভাই ও দুইবোন। কর্মজীবন থেকে পিতাকে অবসর দিয়েছেন আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগেই। পুরো সংসারের ভার নিজের কাঁধে নিয়েছেন। নিজে লেখাপড়া করতে না পারলেও দুই ভাইকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। ছোট দুই ভাইয়ের একজন হয়েছেন প্রকৌশলী এবং অন্যজন আইনজীবী। বোনদের লেখাপড়া করে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। পৈতৃক বাড়ির জায়গা খুব ছোট হওয়াতে নিজেই ৭৫ শতক জায়গা ক্রয় করে তৈরি করেছেন দুইতলা বাড়ি। ১৯৯৮ সনে বিয়ে করেছেন পাশের গ্রাম জয়নগরে। স্ত্রী শিল্পী বেগম, তিন মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে মজিবরের এখন সুখের সংসার। বড় মেয়ে কলেজে পড়ছে, বাকীরা স্কুলে।
মজিবরের খামারে বর্তমানে প্রায় ৬৫টির মতো গরু রয়েছে। সবগুলোই অস্ট্রেলিয়ান জাতের। এখন প্রতিদিন দুধ হয় প্রায় ৮ মণ। তবে গড় হিসেবে দৈনিক নয়-দশ মণ দুধ হয় বলে জানালেন তিনি। বর্তমানে ৩০টির মতো গরু দুধ দেয়। আগামী কোরবানীতে বিক্রি করার উপযোগী ৩টি ষাঁড় এবং বেশ কয়েকটি বাঁছুর রয়েছে। নিজে দুধ দোহান বলে প্রতি লিটার দুধের দাম পান ৫০ টাকা। ঢাকার অভিজাত মিষ্টি প্রস্তুতকারী কোম্পানি বিক্রমপুর সুইটস্ এর কাছে দুধ বিক্রি করেন তিনি। এলাকার মানুষ চাইলেও ফেরত দেন না। স্ত্রী শিল্পী বেগম সংসার ও কর্মচারিদের রান্নাবান্নার পাশাপাশি স্বামীর কাজেও যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। ৫ জন কর্মচারীর বেতন ও সার্বিক খরচ বাদ দিয়ে মাসে এখন লাখ টাকার ওপরে আয় হয় মজিবরের। কোরবানীর ঈদ সামনে তাই কুঁড়া ভুসির দাম বেড়েছে এবং দুধ উৎপাদন কিছুটা কম হওয়াতে লাভের পরিমাণ কিছুটা কম। কোরবানির পর আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে জানালেন তিনি। তখন মাসিক ইনকাম আরো বেশি হবে। নিজের ক্রয়কৃত এবং লীজ নেয়া সহ প্রায় ২২ বিঘা জমিতে গরুর জন্য নেপিয়ার ও জাম্বু জাতের ঘাস চাষ করেন। কিছু জমিতে ধান চাষও করেন। উৎপাদিত ধান দিয়ে সংসারের সারা বছরের চাউলের চাহিদা মিটে যায়। ঘাস পরিবহনের জন্য কিনেছেন পিকআপ ভ্যান। সেটি তিনি নিজেই চালান। সব মিলিয়ে মজিবর এখন কোটিপতি।
মজিবরের এখন আর তাকে টাকার জন্য কোন মাতাব্বরের পেছনে ছুটতে হয়না। বরং নিজের এবং আশেপাশের গ্রামের অনেক যুবকই ছুটে আসেন এখন তার কাছে গরুর খামার সম্পর্কে জানতে ও শিখতে। অনেক যুবক মজিবরের দেখাদেখি উৎসাহিত হয়ে গরুর খামার করছেন। গ্রামের মানুষও তাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন, বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেন। মজিবরও তার কাছে ছুটে আসা মানুষকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন। এলাকার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও সামাজিক কাজে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করেন। কেউ খামার করতে চাইলে পরামর্শ সহযোগিতা দেন। মজিবর এখন কেরাণীগঞ্জের কাঠালতলী গ্রামের এক ভালোবাসার নাম।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসও তাদের আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দাওয়াত করেন তাকে। গরুর রোগবালাই ও স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কোন সমস্যায় পড়লে ফোন করার পর প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তারা ছুটে যান তার খামারে। এখন তিনি শুধু নিজ গ্রাম নয়, আশেপাশের গ্রামের মানুষের কাছেও একজন আদর্শ খামারি।
দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকদের প্রতি মজিবরের পরামর্শ -পরিশ্রম ও লক্ষ্য অটুট থাকলে দেশেই স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব। যে টাকা খরচ করে বিদেশ যেতে হয় তারচেয়ে বরং অনেক বেশি টাকা কামানোর সুযোগ আছে নিজের দেশেই।