নাজমুল হাসান অন্তর : সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই আকাঙ্ক্ষা কবে ভারত সফরে যাবো। আমরা আগেই জানতাম কৃষি অনুষদে পরলে একটা সার্ক কান্ট্রি ট্যুর পাবো। সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসে ২০১৭ সনের আগস্ট মাসে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের ট্যুর পাশ হয়। সবাই এর আগেই পাসপোর্ট ভিসা তৈরি করে রেখেছিলাম। ট্যুর প্লান সাজানো হলো। সবাই নিজ নিজ মত সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছে।
১৭ আগস্ট রাত ০৯ টায় বিশ্ববিদ্যালয় বাসে করে আমাদের বরিশাল দিয়ে আসা হলো। বরিশাল থেকে বেনাপোলের বাস রাত ১২ টায়। সবাই বাসে করে সকাল সকাল বেনাপোল নামলাম। ফ্রেশ হয়েই উদ্দেশ্য ইমিগ্রেশন পাস হওয়া। ইমিগ্রেশন পার হতে প্রায় দুপুর ১২ টা বেজে গিয়েছিল। আমরা দুই গ্রুপে প্রায় ১১০ জন ছিলাম, যার জন্য সময়টা একটু বেশি লেগেছিলো। এর মধ্যেই আমরা আমাদের টাকাগুলো রুপি করে নিয়েছিলাম। হরিদাশপুর থেকে সাড়ে ১২ টার দিকে কলকাতার উদ্দেশ্যে বাস ছাড়লো। আঁকাবাঁকা রাস্তায় বাস ছুটছে ঝড়ো গতিতে। শতবর্ষী গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দুপাশে। কেউ ঘুমোচ্ছে আবার কেউ গান গাইছে, আবার কেউ হয়তো তার প্রিয়জনকে নিয়ে এই শত বছরের পুরনো রাস্তায় হাটার স্বপ্ন দেখছে। যাই হোক বিকাল ৫টার দিকে বাস এসে কলকাতা থামলো।
আমরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে হোটেল ম্যানেজ করে হোটেলে উঠি। হোটেলটা ভালোই বড়, একসাথে আমরা অনেক থাকায় এই হোটেল ছাড়া আর কোনো হোটেলে সিট পাইনি। রাতে পরের দিনের প্লান করে সবাই ঘুমিয়ে পরি। সকালে আমাদের একটা গ্রুপ আলাদা হয়ে আগ্রার উদ্দেশ্যে চলে যায়। আমরা সকালে ঘুম থেকে উঠেই কলকাতার আশেপাশে ঘুরে দেখার জন্য বের হই। সায়েন্স সিটি, ভিক্টোরিয়া, ইডেন গার্ডেনস ভাগ ভাগ হয়ে ঘুরে রাতে যাই হাওড়া ব্রিজে। রাতের দৃশ্য যেন নিজের অজান্তেই মন কেড়ে নিয়েছিলো। আরো অনেক ঘোরার যায়গা ছিল, কিন্তু পরের দিন সকালেই আমাদের ট্রেনের টিকিট কাঁটা ছিলো আগ্রার উদ্দেশ্যে। রাতে হোটেলে ঘুমিয়ে সকাল সকাল বের হই হাওড়া স্টেশনে যাওয়ার জন্য। হাওড়া থেকে সকাল ৯ টা ৪৫ মিনিটে আমাদের ট্রেন। যথা সময় ট্রেন ছাড়লো। ট্রেনে সবাই আড্ডা গানে এমনভাবে মেতে ছিলাম যে, ভুলেই গিয়েছিলাম আমরা বিদেশের মাটিতে আছি। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছিলো বিদেশের মাটিতে কৃষিকাজ, ফসল, ফলাদি। মনে হয়না এ অন্য দেশ। মাঝে মধ্যে কেউ আবার গভীর ঘুমে মগ্ন। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো সময়।
এর মধ্যেই দুপুর, রাতের খাবার আমরা ট্রেনেই সারি। ট্রেনের খাবারের দামটা একটু বেশি হলেও খাবার ভালোই ছিলো। সকাল হয় তখন হয়তো ট্রেন অন্য প্রদেশে। জানালা দিয়ে তাকিয়েই সেই চিরচেনা ইন্ডিয়ানদের হাজার বছরের ঐতিহ্য চোখে পরে। যা নিয়ে ইন্ডিয়াতে সিনেমাও হয়ে গিয়েছে। ট্রেন বিকাল ৪ টার পর আগ্রা এসে পৌঁছালো। সবার মনে আলাদা উত্তেজনা কাজ করছে। সে যেন এক প্রেমের নগরীতে সবার পদধুলি। হোটেলে গিয়ে সবাই ক্লান্তি নিয়ে ঘুম। আমরা কয়েকজন আর আমাদের গাইড স্যার গিয়ে সকালে ঘুরতে বের হওয়ার জন্য সিএনজি ঠিক করে আসলাম। সকাল সকাল উঠেই আমাদের আগ্রা ভ্রমণের মিশন শুরু।
প্রথমেই যাই তাজমহল। যে তাজমহল প্রেমের নিদর্শনের সাক্ষী হয়ে শতশত বছর দাঁড়িয়ে আছে। টিকিট কেটে আমরা তাজমহলে ঢুকি। ভালবেসে মানুষ কি করতে পারে তা তাজমহল না দেখলে বোঝা যাবে না। ঢুকেই আমরা সবাই ছবি তোলা নিয়ে ব্যস্ত কারন আমরা যার গল্প এতদিন শুনতাম তা আমাদের চোখের সামনে। কেউ কেউ তার প্রিয় মানুষকে ভিডিও কল করেও দেখাচ্ছিলো। সবাই মিলে ঘুরে দেখলাম শাহজাহানের সেই অমূল্য সৃষ্টি।
এরপরের মিশন ছিলো আগ্রা ফোর্ট। টিকিট কেটে ঢুকে তো মনে হল আমরা সেই মোঘল আমলে চলে আসছি। বৃহৎ স্থাপনা আর নান্দনিক সব কারুকার্য। প্রতিটি স্থাপনা যেন এক একটি অর্থ বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। ভাল করে সব ঘুরে দেখতে মনে হয় পুরা দিন লেগে যাবে। আমাদের সাথে একজন ইন্ডিয়ান গাইড ছিলো উনি সব সুন্দর করে বর্ণনা করে দিলেন। আমরা প্রায় ৩ টা পর্যন্ত সারা ফোর্ট ঘুরে দেখলাম। তাও মনের মত করে শেষ করতে পারলাম না। তারপর আসে পাশে আড়ো দু-একটি যায়গা ঘুরে আগ্রা মিশন শেষ করলাম। স্বপ্নের স্থাপনায় আজ পায়ের ধুলি পরলো। এ যেন আলাদা প্রশান্তি। সন্ধ্যায় খাওয়া দাওয়া করে রুমে ফিরে আড্ডা আর মাস্তি। এর মধ্যে আমি, রিফাত আর স্যার গেলাম জয়পুর যাওয়ার বাস ঠিক করতে। এসে সবাই লম্বা ঘুম।
সকালে উঠে ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে চললাম জয়পুরের উদ্দেশ্যে। বাসে উঠে তো রীতিমতো অবাক। বাস দোতলা তাতে আবার সুন্দর বিছানা, বালিশ। অবাক হওয়ারই কথা। কারণ, তখনও আমরা এইসব বাসের সাথে পরিচিত ছিলাম না। বাস সকাল ৮ টা দিকে ছাড়লো। যেমন রাস্তা আর তেমনি বাসের গতি। তখন একটাই কথা মনে মনে ভাবছি এমন যদি বাংলাদেশের রাস্তা হত। বাস দুপুর ২ টার দিকে জয়পুরে পৌছালো। বাস থেকে নামার পরই ঝুপ করে বৃষ্টি নামলো। দোকানের পাশে দাড়ালাম তারপরও আমরা একটা কাক ভেজা দিলাম।
এরপর মাহিন্দ্রা এসে আমাদের সবাইকে হোটেলে নিয়ে গেল। হোটেলের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সবাই বিশ্রাম নিলাম। সন্ধ্যায় পরের দিনের বেরানোর বাস রিজার্ভ করলাম। রাতে খাওয়ার জন্য মুসলিম হোটেল খুজতে খুজতে অনেক দূর চলে গেলাম। মোহাম্মাদী হোটেল নামে একটি হোটেলও পেলাম। আমাদের যে রুমে খেতে দেয়া হলো তা তো রীতিমতো এক রাজপ্রসাদ। ভাত না পেয়ে বিরিয়ানি দিয়ে চালিয়ে দিলাম ডিনার। ডিনারের পর স্যারের নিমন্ত্রণে চললাম বিশ্বের ৩য় এবং এশিয়ার সর্ববৃহৎ সিনেমা হল “রাজ মন্দির”এ সিনেমা দেখতে। টিকিটের মূল্যও বেশি ছিলনা। সিনেমা হল না যেন রাজপ্রসাদ। অপরুপ সব কারুকার্য আর দৃষ্টিনন্দন ডিজাইন ও আলোকসজ্জা। টিকিটের মূল্য যেন স্থাপনা দেখেই মিটে গেলো। সিনেমা চলছিলো “টয়লেট – এক প্রেম কথা” এই সিনেমার কথাই আগে বলছিলাম। যদিও সিনেমা দেখতে গিয়ে আমি আর নাজমুল এক ঘণ্টার একটা লম্বা ঘুম দিয়ে ফেললাম। সিনেমা শেষে হোটেলে গিয়ে আবারো লম্বা ঘুম।
সকালে উঠে বাসে করে শুরু মিশন জয়পুর দ্যা পিংক সিটি। বাস শুরুতেই পিংক সিটিতে গেলো। একই রঙ্গের সব বিল্ডিং আর স্থাপনা। চোখ ফিরানো যায় না। তারপর গেলাম হাওয়া মহল। এরপর জলমহল। এটি নিয়ে আলাদা বলার কিছু নাই। বিশাল এক লেকের মধ্যে নান্দনিক এক স্থাপনা। সামনে উট পাওয়া যায়, চাইলে কেউ উটের পিঠে উঠে আলাদা অভিজ্ঞতা নিতে পারেন।
এরপর উদ্দেশ্য আম্বার ফোর্ট। গাড়ি অনেকটা দুরেই থামে যার দরুন হেটে বাকিটা যেতে হয়। কেউ চাইলে আলাদা গাড়ি করেও যেতে পারে। হেটে উঠতে ভালোই কষ্ট হয় কারণ, আম্বার ফোর্টটা পুরোটা পাহারের উপর। আম্বার ফোর্টের আলাদা বর্ননা দিবো না। যোদা আকবর মুভিটার অধিকাংশটাই ওখানে শুটিং হয়েছে। আম্বার ফোর্টের উপর দিক থেকে তাকালে জয়পুরের আসল সৌন্দর্যটা উপভোগ করা যায়। ভেতরের সৌন্দর্য তো বলে বোঝানো যাবে না। এক কথায় এ যেন এক স্বর্গরাজ্য। আম্বার ফোর্ট থেকে নেমে কিছু কেনাকাটি করে সবাই আবার রুমে। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে জয়পুরের রাতের সৌন্দর্য অবলোকন করে এসে হোটেলে আড্ডা তারপর ঘুম। পরের দিনের মিশন দিল্লি। দিল্লীর কাহিনী জানাবো পরের পর্বে।
লেখক: এম এস ছাত্র, কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।