ফকির শহিদুল ইসলাম(খুলনা): প্রায় ৫শ কোটি টাকা ব্যায়ে নৌবাহিনীর তত্বাবধানে সুন্দরবন সংলগ্ন ঘষিয়াখালী নৌ-চ্যানেল সংলগ্ন ৮৩টি খাল ও নদী খনন কার্যক্রম অবশেষে শুরু হয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি পুরণ হওয়ায় এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এই খালগুলি পরিপূর্ণভাবে সচল করা হলে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-রুটটি নাব্যতা ফিরে পাবে এবং রক্ষা পাবে এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, মংলা বন্দরে নৌযান চলাচল ও সুন্দরবনের জীব বৈচিত্র। পাশাপাশি বাড়বে সুন্দরবন নির্ভর মৎস্যজীবীদের কর্মসংস্থান। পরিবর্তিত হবে খাল সংশ্লিষ্ট এলাকার জীবন জীবিকায়ন ।
জানা গেছে, রামপাল মংলার প্রভাবশালী চিংড়ি চাষীরা পরিবেশের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে নদী ও খালে বাঁধ দিয়ে আটকে রেখে চিংড়ি চাষ করে আসছিল। কোনো ভাবেই তাদের আটকানো যেতো না। প্রশাসনের নজরদারী উপেক্ষা করে এখনও অনেক খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ অব্যাহত রেখেছে। এখনও পর্যন্ত শত শত খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ অব্যাহত থাকায় এলাকাবাসী প্রশ্ন তুলেছেন খাল দখলদ্বারদের ক্ষমতার উৎস কোথায়? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য বাগেরহাট জেলা প্রশাসন, রামপাল উপজেলা ও মংলা উপজেলা প্রশাসন দখলবাজদের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষনা করার পরও প্রভাবশালীরা তা মানছে না।
নৌ চ্যানেলটির নাব্যতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত ১৮ মে বৃহস্পতিবার দুপুরে এসব খালের খনন কাজ শুরু করা হয়েছে। রামপাল উপজেলার ঝনঝনিয়া গ্রামের “মুন্সির খাল” খননের মধ্যে দিয়ে এ কাজ শুরু হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাগেরহাট জেলার নির্বাহী প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. জহুরুল ইসলাম এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গত ১৪ মে খনন কাজের কথা থাকলেও দূর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি। পাঁচ’শ ৫০ কোটি টাকা ব্যায়ে প্রধানমন্ত্রী অগ্রাধিকার প্রকল্পের এ খনন কাজের দায়িত্ব পেয়েছেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান “জয় গ্রুপ। তাদের সার্বক্ষনিক তদারকিতে থাকবেন বাংলাদেশ নৌ বাহিনী। সংস্থাটির “ডাইরেক্টর ওয়েলফেয়ার” শাখা এর দেখভাল করবেন বলেও জানান জহুরুল ইসলাম।
বিআইডাব্লিউটিএ এবং রামপাল উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, মংলা বন্দরের সাথে সারাদেশের দূরত্ব কমাতে ১৯৭৪ সালে ৩১ কিলোমিটার দীর্ঘ মংলা-ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌ-রুট চালু হয়। রুটটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পলি পড়ে ২২ কিলোমিটার বন্ধ হওয়ার কারণে ২০১০ সালের পর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় এই চ্যানেলটি। পরে ২০১৪ সালে ২’শ ৪০ কোটি টাকা ব্যায়ে পলি অপসারন এবং দখল করে রাখা সংযুক্ত কয়েক’শ সরকারী খাল খনন কাজ শুরু করে নৌ পথটি পুনরায় চালু করা হয়। তবে চ্যানেলের পাশে ৮৩ টি খাল স্থানীয় প্রভাবশালীরা দখল করে চিংড়ি চাষ করায় নৌ চ্যানেলটির পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হতো। এতে করে আবার পলি পড়ে চ্যানেলটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখা দেয়। এক পর্যায়ে আশংকা করা হচ্ছিলো এসব খাল খনন না করলে দুই থেকে তিন বছর পর চ্যানেলটির কার্যকারিতা হারিয়ে যাবে।
মংলা বন্দর-ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌ চ্যানেল খননের কাজে নিয়োজিত বিআইডাব্লিউটিএ’র প্রকৌশলী (ড্রেজিং বিভাগ) মো. আ. মতিন জানান, চ্যানেল সংযুক্ত খালগুলো দখলে থাকায় নদীর পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হচ্ছিলো। এ কারণে আবার পলির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। খালগুলো পুরোপুরি খনন হলে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে এবং নৌ চ্যানেল সচল থাকবে বলে জানান তিনি।
রামপাল উপজেলার নির্বাহী অফিসার তুষার কুমার পাল জানান, মংলা-ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌ চ্যানেল খননের পরও প্রধান সমস্যা হয়ে দাড়ায় এ চ্যানেল সংযুক্ত ৮৩ টি খাল অবৈধভাবে দখল করে রাখায়। এক শ্রেণীর প্রভাবশালীরা এসব খালে বাঁধ দিয়ে আটকে চিংড়ি ঘের করতেন। এতে করে নৌ চ্যানেলের পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়ে নাব্যতা সংকট দেখা দেয়। প্রভাবশালীরা তারপরও খালগুলো দখলে রেখেছিলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার বলেছেন প্রভাবশালীরা যত বড়ই শক্তিশালী হোকনা কেনো তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে। এরপরে ত্রান ও দূর্যোগ অধিদপ্তর থেকে রামপাল উপজেলায় খাল কাটার জন্য ২’শ ৪০ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হলে এ চ্যানেলের সংযুক্ত খালের ১৫’শ ৮ টি অবৈধ বাঁধ অপসারন করা হয়েছিলো। এরপরও প্রভাবশালীরা খাল দখল করে রাখেন। তাদের কবল থেকে এ খাল উদ্ধার করতে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সার্ভে করার দায়িত্ব দেয়া হলে তারা খাল খননের জন্য পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ে একটি প্রস্তাবনা পেশ করেন। পরে প্রস্তাবনা যাচাই বাছাই করে খাল খননের জন্য ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারী জাতীয় অর্থনৈতিক কমিটি একনেক সভায় সাত’শ ছয় কোটি ৪০ লাখ টাকার প্রকল্প মন্ত্রী সভায় অনুমোদন দেয়া হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় খাল খনন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. আবুল হোসেন জানান, প্রথম পর্যায়ে পাঁচ’শ ৫০ কোটি টাকা ব্যায় করা হবে এ প্রকল্পে । প্রকল্পটি নৌ বাহিনীর তত্বাবধায়নে এ কাজটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান “জয় গ্রুপ কে দেয়া হয়। তারা তিন বছরের মধ্যে এ কাজ সম্পন্ন করবে। তিনি আরো বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে মুন্সির খাল খনন করা হচ্ছে। এরপর ধারাবাহিকভাবে খালগুলি খনন করবেন তারা। মেসার্স জয় গ্রুপের পরিচালক মফিজুর রহমান জানান, খালগুলি যাতে কোনো বাঁধা বিপত্তি ছাড়া দ্রুততম সময়ের মধ্যে খনন করে এর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা যায় সে জন্য তিনি প্রশাসনসহ সকলের সহযোগীতা কামনা করেছেন।
নদী গবেষক মো. শাহাবুদ্দিন শিকদার জানান, এ নৌ রুটটির নাব্যতা রক্ষায় যা করণীয় সেটি হলো, চ্যানেল সংলগ্ন ৮৩ টি নদী খাল দ্রæত খনন করা, এ চ্যানেলের অন্যতম শাখা নদী দাউখালী উপর নির্মিত সুইস গেট ও বক্স কালভার্টসহ সকল বাঁধা অপসারণ করা, সংরক্ষন ড্রেজিং অব্যাহত রাখা, জলাভূমি উন্মুক্তকরণ ও টাইডাল বেশিন নির্মান করে স্বাভাবিকভাবে পানির প্রবাহ বৃদ্ধি করতে হবে। এ জন্য তিনি কর্তৃপক্ষের আরও নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান।
এদিকে মংলা-ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌ চ্যানেল রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব এম,এ সবুর রানা জানান, চ্যানেল সংযুক্ত ৮৩ টি খাল খনন করলেই হবেনা, এর পাশে আরো বিল ও জলাভূমি আছে সেগুলোও উন্মুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, খাল খননের জন্য যে টাকা বরাদ্ধ হয়েছে তা যেন সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়।