এ কিউ রাসেল, গোপালপুর (টাঙ্গাইল) : চলতি অর্থ বছরেই দেশের গন্ডি পেরিয়ে ইউরোপিয়ো ইউনিয়নে রপ্তানি হতে যাচ্ছে টাঙ্গাইলের মধুপুরের আনারস। সরকারি প্রতিষ্ঠান হর্টেক্স ফাউন্ডেশন এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ অর্গানিক পদ্ধতিতে ফলানো আনারস চলতি অর্থ বছরেই ইউরোপিয়ো ইউনিয়নে রপ্তানি করা হবে।
হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে বিশ্বের অন্যন্য দেশের রপ্তানি হবে মধুপুরের আনারস। সম্পূর্ণ অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষ করা আনারসে দ্রুত বৃদ্ধির জন্য হরমোন এবং পাকানোর জন্য কোন ধরনের রাইপেনার (ইথোফেন) ব্যবহার করা হয় না। উন্নত বিশ্বে ফল পাকানো জন্য গ্যাসীয় পদ্ধতি অনুমোদিত। আগামী বছর থেকে মধুপুরে উন্নত বিশ্বের মত গ্যাসীয় পদ্ধতিতে আনারস পাকানোর জন্য সরকারিভাবে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে আনারসের বাম্পার ফলন হয়েছে। উৎপাদিত আনারসের পরিমান প্রায় ২ লাখ ৯ হাজার ৫১২ মেট্রিক টন। ফলে টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে আনারসের সরবরাহ রয়েছে প্রচুর। এবার বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিকমুক্ত আনারস হওয়ায় কদর বেড়েছে মধুপুরের আনারসের। ফলে লাভের মুখ দেখছে মধুপুরের আনারস চাষিরা।
টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলা জুড়েই আনারস চাষ হয়। তার মধ্যে অরণখোলা, শোলাকুঁড়ি, আউশনাড়া ইউনিয়নে আনারসের চাষ সবচেয়ে বেশি হয়। এসব এলাকায় চাষ হওয়া আনারসের মধ্যে সুস্বাদু, রসালো ও মিষ্টি হওয়ায় জনপ্রিয় জাত দুটি হলো- জায়ান্টকিউ ও হানিকুইন। হানিকুইন আকারে ছোট এবং স্থানীয়ভাবে ‘জলডুগি’ নামে পরিচিত। মধুপুরে জায়ান্টকিই জাতের আনারসের চাষই সবচেয়ে বেশি হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে, এ বছর মধুপুরে ৬ হাজার ৫৭১ হেক্টর জমিতে আনারসের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ৬ হাজার ৩৮০ হেক্টর জমিতে জায়ান্টকিউ এবং ১৯০ হেক্টর জমিতে হানিকুইন জাতের আনারস চাষ হয়েছে।
মধুপুরের শালবন লাগোয়া গ্রাম গুলোতে শুধুই আনারসের বাগান, এখন এই বাগানগুলোতে এই সময়ে পাকা আনারসের আধিক্য দেখা যায়। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, প্রাকৃতিকভাবে আষাঢ়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শ্রাবণ মাসের শেষ পর্যন্ত আনারস পাকার মৌসুম। তবে মধুপুরে সারা বছরই আনারস বাজারে পাওয়া যায়।
মধুপুরের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মাহামুদুল হাসান এ বছর আনারসের চাষ ও রপ্তানি প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ বছর মধুপুরে আনারসের বাম্পার ফলন হয়েছে। আমরা আশা করছি, এবার প্রায় দুই লাখ নয় হাজার পাঁচশো বারো মেট্রিক টন আনারসের উৎপাদন হবে। উপ-সহকারি কৃষি অফিসারগণ ও আমি নিজে তত্বাবধায়ন করেছি যেন কোন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার না করে। সুখবর হচ্ছে, এই অর্থ বছর থেকেই হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অর্গানিক পদ্বতিতে উৎপাদিত মধুপুরের এই আনারস ইউরোপিয়ো ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হবে। এই বছর আনারস চাষের প্রথম পর্যায়ে বৃদ্ধির জন্য হরমন এবং পাকানোর ক্ষেত্রে রাইপেনার (ইথোফেন) ব্যবহার করা হয়নি। তাই মধুপুরের আনারস খাবার ক্ষেত্রে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। আমি নিজেও মধুপুরের আনারস খাই।’
আনারসের পুষ্টিগুণ এবং চাষের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার প্রসঙ্গে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বাবিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি ও পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান, সহযোগি অধ্যপক ড. মো. আবু জোবায়ের বলেন, ‘টাঙ্গাইলের আবহাওয়া বিশেষ করে মধুপুর অঞ্চলের আবহাওয়া আনারস চাষের উপযোগি। আনারসে আছে ভিটামিন সি, যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, বিভিন্ন ধরনের মিনারেল যেমন- পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, যা দেহের এই সব মিনারেলের অভাব পূরণ করে। এছাড়া আনারসে আছে ফাইবার যেটা আমাদের হজমে সহায়তা করে। তবে অতি মুনাফা লাভের আশায়, কৃষক থেকে শুরু করে বিক্রেতা পর্যন্ত সবাই বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে থাকে আনারসে। যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। এই ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজর রাখা দরকার।’
মধুপুরে আনারসের বাজার রয়েছে, জলছত্র, গারো বাজার, মধুপুর বাজার ও ২৫ মাইল বাজার। সকাল থেকেই এসব বাজারে আনারস চাষিরা তাদের বাগান থেকে কাটা আনারস বিক্রির জন্য বয়ে নিয়ে আসে এসব বাজারে। কেউ বা সাইকেলে ঝুলিয়ে, কেউ ঘোড়ার গাড়িতে, পরিমানে বেশি হলে পিকআপ ভ্যানে করে বিক্রি করতে নিয়ে আসে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আনারস ব্যবসায়ীরা এসব বাজারে আনারস ক্রয় করতে আসেন। অনেক সময় বাজারে আনারস নিয়ে আসার পূর্বেই আনারস চাষিদের কাছ থেকে এসব পাইকার পথ থেকেই আনারস কিনে নেয় কম দামে। তারপর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে বিক্রি করেন। বিশেষ করে জলছত্র বাজার মহাসড়ক ঘেঁষে থাকায় এই বাজারেই বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর অবস্থান, বেচাকেনা বেশি হয় এই বাজারে।
মধুপুর উপজেলার আনারস চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ বছর আনারসের ফলন ভালো হয়েছে। গরমের কারণে আনারসের চাহিদা বেশি, বিক্রিও বেশি। এ প্রতিবেদকের কথা হয় আনারসের পাইকারী বিক্রেতা মো. আবদুস সালাম ও মো. তোরার আলী সাথে। তাদের কথার সাথে কৃষি বিভাগের তথ্যর মিল পাওয়া গেল।
তারা বলেন, ‘আমরা প্রতি বছর অগ্রীম আনারসের বাগান কিনে তারপর আনারস পাকলে টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় আনারস পাঠাই। এ বছর আনারস বৃদ্ধির জন্য কোন ধরনের হরমোন ব্যবহার করা হয়নি। আর পাকানোর জন্য কোন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়নি। কৃষি বিভাগের তৎপরতা এবং প্রশাসনের নজরদারির কারণে এবার সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে আনারস ফলানো হয়েছে এবং বাগানেই পেঁকেছে।’