শুক্রবার , নভেম্বর ২২ ২০২৪

পৃথিবীর স্বর্গ কাশ্মীর কাহিনী (পর্ব-১) !

আইমান সাদ: ঢাকা থেকে বাসে বেনাপোল বর্ডার গেলাম প্রথমে। ইন্ডিয়ান কাস্টমস সাথে এক হাজার রূপি থাকার অপরাধে ৩০০ রূপি ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দিলো। এরপর ৩০ রূপি দিয়ে বনগাঁ রেলস্টেশন, সেখান থেকে ২০ রূপিতে ট্রেনে শিয়ালদহ। সারাদিন কোলকাতা ঘুরে সন্ধায় এলাম সুভাষ চন্দ্র ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ। রাত ৯ টায় উঠলাম জেট এয়ারওয়েজের একটা বড়সড় বিমানে। এই বিমানের এয়ারক্রুরা বেশ স্মার্ট ছিলো (আমি মেয়েদের কথা বলতেছি)! দেখেই মন ফ্রেশ হয়ে গেলো। বিমান আকাশে উড়ার সাথে সাথে একটু গরম লাগা শুরু হয়েছিলো। কিন্তু অনেক টানাটানি করেও জানালা খুলতে পারিনি।

আমাদের হোটেলের জানালা দিয়ে তোলা ছবি।

পরে বুঝেছি বিমানে এসি ছিলো! তখন ঠান্ডায় জমে গেছিলাম। ঠাণ্ডা দূর করার জন্য এয়ারক্রুরা ওয়েটার সেজে বেশকিছু আইটেমের খাবার দিলো। খুবই টেস্টি এবং মিস্টি। ইয়ে মানে মিস্টি মেয়েটার কথা মনে পড়ছে খুব।:(মেয়েটাকে চোখ টিপ দিয়েছিলাম। আমাকে পালটা হাসি দিয়ে চোখ টিপে দিয়েছিলো। বিমানভাড়া এইখানেই উসুল হয়ে গেছিলো আরকি!

প্রায় দুই ঘন্টা পর দিল্লী নেমে বিমান পালটে জম্মু হয়ে শ্রীনগর পৌছলাম পরদিন দুপুর এক্টায়। এয়ারপোর্ট নেমেই কাশ্মীরের রূপ দেখা শুরু। কিন্তু কাশ্মীর দেখলাম কেমন অন্ধকারময়। মন খারাপ হওয়া শুরু হইতেছিলো। সানগ্লাসটা চোখ থেকে নামানোর পর দেখি, নাহ! সব ঠিকই আছে।

পাইন গাছের নিচে মেঘ লুকিয়ে আছে।

এয়ারপোর্ট নামার সাথে সাথেই বেশকিছু ট্যাক্সি ড্রাইভার/বোট হাউজ দালাল ঘিরে ধরলো। আমি ট্যাক্সি নেয়ার বিলাসিতা না করে বাসে ৩০/- ভাড়া দিয়ে চলে গেলাম লালচক। সেখান থেকে আবারো অটোতে করে ১০০/- টাকায় “ডাল লেকে”! ওখানে গেলে আবারো ঘিরে ধরে একঝাক বোট হাউজ মালিক/কর্মচারী। ডাল লেকের শুরু থেকে শেষ মাথা অব্দি অনেকগুলো গেট বা ঘাট। এসব ঘাট ১, ২, ৩ এভাবে নাম্বার দেয়া। ঘাটের সংখ্যা যতো বাড়বে “বোট হাউজের” দাম তত কমবে কিন্তু সৌন্দর্য আরোও বাড়বে। আমরা ছিলাম মূল লেকে, ঘাট নাম্বার ১৭ তে। এসব ঘাট থেকে ছোট নৌকায় করে লেকের উপারে থাকা বোটে নিয়ে যাওয়া হয়। বোট হাউজটা খুব সুন্দর ছিল। (আসলে সবই সুন্দর)! এক রাত ছিলাম ১০০০/- রূপিতে (বাংলা টাকায় ১৩০০/- প্রায়)। বোট হাউজে আমাদের পারাপার করছিলো সৈয়দ রেহান নামে এক স্মার্ট মাঝি। শখের মাঝি মূলত ছাত্র। সে আমাদের ভাসমান মার্কেটে নিয়ে গিয়েছিলো শখ করে। আমি ওর ছবি তুলেছি। ছবি ভালো আসে নাই বলে মাঝি খুব মন খারাপ করে।

ডাল লেক নাম শুনে কেউ আবার এই লেকের পানি দিয়ে ভাত খাওয়ার চিন্তা কইরেন না। ডাল লেকের পানিতে ডাল নেই, একেবারে সাদামাটা পানি। লেকের একপাশে বিশালাকার পাহাড়। পাহাড়ের সাথে লেকের পানির সৌন্দর্য কোন ক্যামেরায় তুলে আনা সম্ভব নয়, আমিও পারিনি।

বিকেলবেলা লেকের পানিতে ২০০/৩০০ রূপিতে এক ঘন্টার জন্য নৌকা ভ্রমণ করা যায়, স্থানীয় ভাষায় একে “শিকারা রাইড” বলে। ভালোই লাগছে এটা।

শখের মাঝি সৈয়দ রেহান। সত্যিই বেচারার আসল চেহারা ছবিতে আসে নি।

ডাল লেকের সাম্নের রাস্তার ফুটপাতে বিকেল হলে হকাররা বসে স্থানীয় শাল, চাদর, বাদাম ইত্যাদি আইটেম বিক্রির জন্য। দাম খুব কম মনে হইছে আমার। কোয়ালিটি ভালো। আপেলের কেজি ৫০ রূপি। যদিও “বিটিভির বাতাবি লেবু” সাইজের আপেলগুলা পানসে।

কাশ্মীরে সন্ধ্যা হয় “রাত আটটায়”, সিংগাপুরের মতো। তবে শ্রীনগরের ডাল লেক এলাকা ছাড়া অন্যান্য এলাকা সন্ধ্যার পরই জনশূন্য হয়ে যায়। শ্রীনগরের পথে পথে প্রচুর কুকুর দেখা যায়। বিশালাকার লোমশ পাহাড়ি কুকুরগুলো দেখতে ভয়ানক হলেও আচরণে ভালো। ঘেউঘেউ দূরে থাক, মেউ মেউ’ও করে না।

বোট হাউজ থেকে পুরো ডাল লেক দেখা যায়। কিন্তু এসব বোট হাউজে একদিনের বেশী থাকার কোন মানেই হয় না। অনেক ব্লগে বোট হাউজের যতো আজাইরা প্রশংসা শুনেছি সেই অনুযায়ী আমার কাছে তেমন ভালো লাগে নি। কাপল গেলে এসব বোট হাউজে না উঠাই ভালো। কারণ একটু জোরে হাটলেই বোট হাউজ দোলতে থাকে।

আবার এসব বোট হাউজের মালিকেরা সবাই প্যাকেজ ট্যুর অফার করে। ভুলেও নিবেন না। এঁদের এইসব অফার থেকে বেচে থাকাটা কাশ্মীরের একমাত্র চ্যালেঞ্জ। কাশ্মীর ভ্রমণ ব্যয়বহুল হয়ে যায় এঁদের প্যাকেজের কারণেই। আমরা রীতিমতো যুদ্ধ করে আমাদের বোট মালিকের অফার ফিরিয়ে দিয়ে পরেরদিন গেট নং ২ এর পাশে হোটেল তুলি’তে উঠলাম। অসাধারণ রূম মাত্র ৯০০ রূপিতে। ৩ জন অনায়াসে থাকা যাবে, তবে মেসে থাকার অভিজ্ঞতা থাকলে ৪ জনও থাকতে পারবেন। সেক্ষেত্রে অবশ্য সবাইকে একই জেন্ডারের হতে হবে।

বোট হাউজের ভিতরে অভ্যর্থনা কক্ষ, ভদ্র ভাষায় ড্রইং রুম।

শ্রীনগরে দেখার মতো ডাল লেক ছাড়া কয়েকটি বাগান আছে যেগুলা সম্রাটরা বানাইছিলেন মূলত ”হেরেম” হিসেবে। এগুলা দেখার চেয়ে আমাদের বোটানিক্যাল গার্ডেন দেখা ২০৫ গুণ ভালো। তবে হযরতবাল দরগাহ দেখে আসুন। ওটা একটা মসজিদ যদিও, কিন্তু ছেলে মেয়ে সবাই ঢুকতে পারে। অটোতে করে ডাল লেক থেকে ১৫০ রূপি করে নিবে। একটা অটোতে ৪ জন আরামসে বসা যায়।

শুধু শ্রীনগরের নয়, পুরো কাশ্মীরের খাবার খুবই টেস্টি। এদের ভাতগুলো লম্বায় ছোটখাটো খাম্বার সমান। দাম কক্সবাজারের চেয়েও কম। ঘুরতে গেলে পেটপুরে খাওয়ার নিয়ম। তাই খাবেন প্রচুর। আর খাওয়ার জন্য শ্রীনগরের লেকের পাশের রেস্টুরেন্টগুলোই ভালো, চাইলে ”লালচক”ও যেতে পারেন।

শ্রীনগরে একটা বাজারে সেদিন স্বাধীনতাকামীরা হামলা চালাইছিলো পুলিশের উপর। তাই দুইবার চেকিং-এর মুখোমুখি হইছিলাম। যেখানেই শুনে ট্যুরিস্ট, সাথে সাথে পুলিশের ব্যবহার হয়ে যায় অমায়িক। রাগী পুলিশও আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে “কেমন লাগলো কাশ্মীর?” যেন আমাদের মুখের হাসিটাই এঁদের একান্ত কাম্য। এছাড়াও সার্বক্ষণিক প্রস্তুতি নিয়ে পুলিশী পাহারা চোখে পড়বে কাশ্মীরের সর্বত্র, যেন এখুনি যুদ্ধ শুরু হচ্ছে। ভয় নেই। আমার বিশ্বাস কাশ্মীর দুনিয়ার সবচে’ নিরাপদ ট্যুরিস্ট স্পট।

যাতায়াতের জন্য আমরা শেয়ারিং জীপ কিংবা মিনিবাস কিংবা অটো ব্যবহার করেছি। এতে যাতায়াত খরচ ১০ ভাগ কমে যাওয়ার পাশাপাশি লোকাল কাশ্মীরিদের সান্নিধ্য পাওয়া গেছে। অথচ যাতায়াত রিজার্ভ জীপের মতোই আরামদায়ক ছিলো।

কাশ্মীরি মেয়ে বিয়ে করার শখ সেই ছোটবেলা থেকে। এক দেশী কাশ্মীরী আগেই আমারে পটায়া বিয়ে না করলে একটা চান্স নিতাম। শুনেছিলাম এরা রূপসী হয়। শ্রীনগর ঘুরে এমন শতশত কাশ্মীরী মেয়ে দেখলাম যারা একেকজন ক্যাটরিনা কিংবা জাহেদা। অনন্তনাগের একটা গার্লস স্কুলের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জ্ঞান হারানোর দশা হইছিলো। পুরো কাশ্মীরে প্রায় ২০-২৫ জনের উপর সিরিয়াস টাইপের ক্রাশ খাইছি কিন্তু কেউই বুঝে নাই। লোকাল মিনিবাসে এমনই এক মেয়ের সাথে পরিচয় হইছে, নাম মেহেক। তার মা বাঙালি। মেয়েটাকে নাকি বাংলাদেশে এক ছেলে “আমি তোমাকে ভালোবাসি ” বলেছিলো। সে তখন একেবারেই বাংলা জানতো না, তাই ”হ্যা” বলে দিয়েছিলো। আমি শুনে হাসতে হাসতে “আমিও ভালবাসি” বলেছি। মেহেকের ছবি তুলেছি, কিন্তু ফেসবুকে দেয়া যাবে না এমন শর্ত ছিলো।

এছাড়া শ্রীনগরের পথে পথে শতশত নায়কও ঘুরে বেড়ায়। এদের কেউ কেউ ট্রাক ড্রাইভার, কেউবা বাসের হেল্পার, কেউ আবার রাস্তার ধারে ভূট্টা বিক্রি করে।

কাশ্মীরকে শুধুমাত্র এর সৌন্দর্যের জন্য “ভূস্বর্গ” বলা হলে সেটা অতি অবশ্যই ভুল। কাশ্মীর ভূস্বর্গ হয়েছে সেখানকার মানুষের ব্যবহারের কারণে। যখনি এরা বুঝবে যে আপনি অতিথি, তাও আবার বাংলাদেশ থেকে; আপনাকে খুব সমীহ করবে। নিজে থেকে যেচে কথা বলার মতো এতো আন্তরিকতা দুনিয়ার আর কোথাও আছে কিনা আমার জানা নেই। মুসলিম পরিচয় পেলে আরো খুশি হয়। কাশ্মীরের লোকজন যথেষ্ট গরীব হলেও এঁদের ব্যক্তিত্ব আপনাকে মুগ্ধ করবে। রাস্তাঘাট যথেষ্ট পরিষ্কার। অযথা গাড়ীর প্যাঁ প্যাঁ নেই। শহরের বাড়ীগুলোর ডিজাইন দেখলে মনে হবে এরা বুঝি সবাই কোটিপতি। একটা বাড়ী থেকে অন্যটার যথেষ্ট দূরত্ব আছে। এসব দেখে আমার মতো আপ্নারও থেকে যেতে মন চাইবে বিপদজনক এই উপত্যকায়।

 

This post has already been read 8680 times!

Check Also

বইমেলায় আসছে দেশসেরা ভ্রমণ লেখকদের বই ‘ট্রাভেলার’

এগ্রিনিউজ২৪.কম: দেশে যেন ভ্রমণের জোয়ার শুরু হয়েছে। তরুণদের পাশাপাশি সববয়সী মানুষ দেশের এ স্থান থেকে …