মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর) : সাফল্য,উদ্ভাবনী অগ্রগতি অার ঐতিহ্য নিয়ে ৩৩ বছর পার করেছে চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। ১৯৬০ সালে চাঁদপুর জেলা শহরের পূর্ব প্রান্তে ১৩ হেক্টর এলাকা নিয়ে চাঁদপুর নদী গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ।
সাধু পানির মৎস্য গবেষণা কেন্দ্র, টেকনোলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও ট্রেনিং ইন্সটিটিউট নামে একই সাথে ৩টি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে এখানে। ফলে মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট সদর দপ্তরসহ ৪টি কেন্দ্রের অন্যতম নদী কেন্দ্র চাঁদপুরকে করা হয়।
১৯৮৪ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের আমলে এক অধ্যাদেশ বলে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট বা জাতীয় মৎস্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি স্বীকৃতি পায় ।
পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে অপর এক সরকারি আদেশ বলে মৎস্য গবেষণার সদর দপ্তর চাঁদপুর থেকে ময়মনসিংহস্থ স্বাদু পানির কেন্দ্রের স্থাপনটি স্থানান্তার করা হয় । ১৯৮৮ সালে সরকারি আদেশ বলে এখানে একটি জেলা মৎস্য কর্মকর্তা দপ্তর প্রতিষ্ঠা পায়।
সারাদেশে এ ধরনের ৩টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এগুলো হলে যথাক্রমে চাঁদপুর, ময়মনসিংহ ও শরীয়তপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ের অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন মৎস্য প্রজাতির সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে।
সম্প্রতি তাদের এক প্রকশনা তথ্যে জানা যায়, চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বিগত ৩৪ বছরে মৎস্য নিয়ে ৫০ টির মতো প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এসব প্রযুক্তিগুলো দেশের আমিষের চাহিদা পূরণে অসামান্য অবদান করে রেখে আসছে। পাশাপাশি নতুন নতুন কর্মসংস্থান ও দরিদ্র বিমোচনে কাজ করছে ।
প্রতিষ্ঠাকালে থেকে ২০১৭ পর্যন্ত নদী গবেষণা কেন্দ্র চাঁদপুর ওইসব গবেষণামূলক প্রযুক্তির উদ্ভাবন করে। বিশেষ করে ইলিশ সম্পদ রক্ষায় চাঁদপুর নদী গবষেণা কেন্দ্রটি একটি যুগান্তরকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছে ।
দেশের জিডিপিতে যোগ হয়েছে অর্থনৈতিক সূচক। প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে-ইলিশ সম্পদের সংরক্ষণ কৌশল ও ব্যবস্থাপনা, পুকুরের পাঙ্গাস চাষে একক ও মিশ্র চাষাবাদে প্রযুক্তি, থাই পাঙ্গাস চাষের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা চাষের উৎপাদন, প্যানে মাছ চাষের কলা-কৌশল, গৃহাঙ্গন হ্যাচারীতে গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন, পুকুরের গলদা চিংড়ির একক ও মিশ্র চাষ, ধান ক্ষেতে মাছ চাষ, মাছ ও জলজ পরিবেশরে ওপর কীট নাশকের বিষক্রিয়া নিরূপণ, কাপ্তাই হ্রদের জৈব ব্যবস্থাপনা ও জলাশয় তাত্তিক সমীক্ষা, খাঁচায় তেলাপিয়া মাছ চাষ, প্যানে মাছ চাষ, নদ-নদীর পানির নবায়ন ও দূষণ বিষয়ক সমীক্ষা, ইলিশ মাছ গবেষণা ও ব্যবস্থাপনা, শিলন মাছের প্রতিপালন ও গবেষণা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট চাদঁপুরের সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাগণ প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ওই সব নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেন । যার সুফল সারা দেশব্যাপি ছড়িয়ে দিতে সামর্থ্য হয় । এ সফল প্রয়োগ ও যোগ্য প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে দেশের মৎস্য সম্পদের যথেষ্ট উন্নতি সাধন হয়েছে। যার ফলে এক সময়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন ছিল।
২০১৭ সালের সর্বশেষ তথ্য মতে সব উৎসের মাছ উৎপাদন হচ্ছে ৮০ লাখ ৯শ’৭৬ মে.টন। চাঁদপুর জেলায় মাছের চাহিদা ২০১৬-২০১৭ সালের হিসেব মতে জনপ্রতি ৫৮ গ্রাম হারে ২৫ লাখ মানুষের বছরে ৫১ হাজার ১শ’৪৭ মে.টন। মাছের উদ্বৃত্ত উৎপাদন হলো ২৯ হাজার ৮শ ২৯ মে.টন ।
একাধিক বার রাষ্ট্রপতি কর্তৃক পুরষ্কার প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ও স্বীকৃতি পেয়েছে এ কেন্দ্রটি। এটি এখন চাঁদপুরবাসীর ও গর্বের বিষয় । ইলিশের ব্র্যান্ডিং এ সু-খ্যাতির অংশীদার। দেশে সর্বপ্রথম থাই পাঙ্গাসের সফল প্রজনন, ইলিশ মাছের ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং খাঁচায় মাছ চাষে উদ্ভাবনীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান এ কেন্দ্রে বিজ্ঞানীদের রয়েছে।
গবেষণা পরিচালনা ও গুরুত্ব বিবেচনা করে এখানে বেশ ক’জন পিএইচডি বিজ্ঞানীও রয়েছেন । নদীর চলমান গবেষণার জন্যে ও গবেষণা কাজ ও পোনার চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে এখানে ছোট বড় ৪০ টি পুকুরে রুই ,কাতলা ,মৃগেল , ব্রিগহেড , মিরর কার্প, দেশি ও থাই পাঙ্গাস , গিফট তেলাপিয়া , থ্ইা সরপুটি, রিটা , বাগাইড ,চিতল .ফলি , ভাগনা , পাবদা ,টেংরা , গলদা , চিংড়ির বিভিন্ন আকৃতির ব্রুড ও পোনা উৎপাদন করে বাণিজ্যিকভাবে জেলার শ’ শ’ মৎস্য হ্যাচারির মধ্যে বিক্রয় ও বিতরণ করা হচ্ছে।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো.ইশতিয়াক হায়দার বলেন,‘ বর্তমানে চাঁদপুর নদী গবেষণা কেন্দ্রে ৫টি গবেষণা প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। মেঘনা নদীর ৬০টি স্পটের পানি সিঙ্গাপুর গবেষণাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। বর্তমানে ইলিশ রক্ষায় ১ মাসব্যাপি অভয়াশ্রম রক্ষায় গবেষণার কাজ চলছে । চাঁদপুরের এ প্রতিষ্ঠানটি বসে নেই ।’
এ ব্যাপারে কর্মরত ইলিশ গবেষক ও বিজ্ঞানী ড.আনিসুর রহমান জানান, এ কেন্দ্রটি বিগত ১৭ বছরে ধরে বেশ ক’টি নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে । এর মধ্যে ইলিশ মাছ গবেষণা ও খাঁচায় মাছ চাষ অন্যতম । ২০০৩ সালে থেকে জাটকা ও মা ইলিশ রক্ষায় কর্মসূচি পালনে দেশের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি হয়ে প্রায় ৫ লক্ষ মে.টনে পৌঁছেছে।
ব্র্যান্ডিং জেলা চাঁদপুরের ইলিশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বছরে ইলিশ রপ্তানি খাত থেকে কোটি কোটি টাকা আয় আসছে। পৃথিবীর সকল দেশেই এ ইলিশের চাহিদা বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমানে জাটকা সংরক্ষণ পদ্ধতি জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান ও গবেষণা ইলিশের বায়োলজিক্যাল স্টাডি, ইলিশর প্রজননের ক্ষেত্রে জাটকা বিচরণ ক্ষেত্রের পরিবর্তন, পর্যবেক্ষণ ও নতুন নতুন ক্ষেত্র চিহ্নিত প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণালব্ধ কার্যক্রমে অব্যাহত রয়েছে।’এছাড়া মা ইলিশ ও জাটকা রক্ষায় চাঁদপুরের মানুষ আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ইলিশের এ গবেষক আরো বলেন, ‘ ইলিশ সম্পদের সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধি জাটকা রক্ষায় ইলিশের অভয়াশ্রম সংরক্ষণ ও মা ইলিশ রক্ষায় এ কেন্দ্রটি ভূমিকা পালন করছে । সমুদ্রে ইলিশ রক্ষায় বিমান বাহিনীকেও যোগ করা হয়েছে। মা ইলিশ মাছ ডিম পাড়ায় দেশের সকল অভায়শ্রমগুলো বিমান বাহিনী টহল দেবার প্রস্তাব রাখা হয়েছে।’
নদী গবেষণা কেন্দ্রের চীফ সাইন্টিফিক অফিসার ড.মাসুদ হোসেন খান বলেন, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর দূষণের প্রকৃতি নির্ণয়, জলজ প্রাণীর ক্ষতিকর প্রভাব, হিলশা ম্যানেজম্যান্ট একশন প্লান্ট, জলবায়ূর পরিবর্তন ও এর প্রভাব , ২০১৬-২০১৭ সালে বোয়াল মাছের প্রজনন ও প্রাকৃতিকভাবে পোনা সংরক্ষণ, তেলাপিয়ার রোগ ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে চাঁদপুর এ নদী গবেষণা কেন্দ্রটি কাজ করছে।এছাড়াও নদী সম্পদ সংরক্ষণ ও নদী দূষণ, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সংরক্ষণ ও জলজ পরিবেশ সংরক্ষণেও তাদের অনেক অবদান রয়েছে ।