মো. সাজ্জাদ হোসেন: পোল্ট্রি মুরগি কেনো এত বাড়ে? মাত্র ২৮ থেকে ৩০ দিনে কিভাবে এক/দেড় কেজি ওজন হয়? তাহলে কী এতে হরমোন দেয়া হয়? গরুকে মোটাতাজা করার জন্য যেমন ইউরিয়া ব্যবহার করা হয় সে ধরনের কিছু কি দেয়া হয়? এমন সন্দেহ শুধু সাধারণ মানুষই নয়; সংবাদকর্মীদের মাঝেও এ সন্দেহ প্রকট। বিপিআইসিসি’র উদ্যোগে গত প্রায় তিন বছর ধরে চলা পোল্ট্রি রিপোর্টিং বিষয়ক মিডিয়া কর্মশালার অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে।
পোল্ট্রি শিল্প সম্পর্কে সংবাদ কর্মীদের পরিস্কার ধারনা দেয়া, প্রয়োজনীয় তথ্য তাঁদের হাতে পৌঁছে দেয়া এবং জনমনে যেসব বিভ্রান্তি রয়েছে সে বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তুলে ধরার জন্য বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) ২০১৬ সাল থেকে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কর্মরত জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক, টিভি চ্যানেল এবং অনলাইনের রিপোর্টারদের জন্য পোল্ট্রি রিপোর্টিং বিষয়ক কর্মশালার আয়োজন করে আসছে। এ সময়কালে, রাজশাহী, বগুড়া, জয়পুরহাট, যশোর, টাঙ্গাইল, রংপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল শহরে একটি করে এবং ঢাকায় দুইটি মিডিয়া কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। লক্ষ্যণীয় বিষয়টি হচ্ছে দু-একটি বাদে প্রায় প্রতিটি কর্মশালাতেই সাংবাদিকরা যে প্রশ্নগুলো করেন তার মধ্যে প্রায় অবশ্যম্ভাবীভাবেই হরমোন’ প্রসঙ্গটি থাকে। গত ১ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়ের সংবাদকর্মীদের জন্য ঠাকুরগাঁও শহরে আয়োজিত কর্মশালাটিতেও এ প্রশ্নটি ঘুরে ফিরে এসেছে।
রাজধানীতে বসে আমরা যারা পোল্ট্রি নিয়ে কথা বলি তাঁদের অনেকেরই অভিমত পোল্ট্রিতে হরমোন বা ট্যানারির বর্জ্য’ এই ইস্যুগুলো এখন সেটেলড ইস্যু। এগুলো সম্পর্কে এখন মানুষ জানে, বিভ্রান্তি কেটে গেছে। তাই এতোদিন পরে এসে এ বিষয়ে কথা বলার কোন মানে নেই। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। সংবাদকর্মীরা যদি নিজেরাই এই সন্দেহের আবর্তে এখনও ঘুরপাক খান তবে তাঁদের হাত দিয়ে বেরিয়ে আসা রিপোর্টেও যে তার প্রতিফলন থাকবে সেটাই তো স্বাভাবিক! আর সে কারণেই স্বস্তির নিঃশ্বাস না ছেড়ে বরং বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেয়ার দরকার আছে। মেয়াদকাল ৩৫ দিন থেকে ২৮-৩০ দিনে নেমে আসাতেই যদি এ অবস্থা হয় তবে এ সময়কাল যদি আরও কিছুটা কমে কিংবা এ মেয়াদকালেই যদি গ্রোথ আরও কিছুটা বাড়ে তখন কি অবস্থা হবে? অনেকেই সে কারণে বলছেন একটা বা দু’টা কর্মশালা কখনই যথেষ্ঠ নয়। ফলোআপ ট্রেনিং বা কর্মশালা খুবই দরকার। তাছাড়া একটি জেলা থেকে কর্মশালা শেষ করে পুনরায় সে জেলায় ফিরে যেতে যেতে মাঝখানে যে সময় চলে যাবে সে সময়ে পোল্ট্রি জগতের যে পরিবর্তন সাধিত হবে তার আপটেডটা জানানো এবং একইসাথে সারাদেশের সংবাদকর্মীরা যেন পোল্ট্রি বিষয়ে তাদের রিপোর্টিং কনটিনিউ করতে থাকেন সে বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে।
সে যাই হোক পোল্ট্রিতে হরমোন ব্যবহারের কথাটি যে সত্য নয় সে সম্পর্কে আমার হাতে কিছু তথ্য প্রমাণ আছে তাই বিষয়টি মিডিয়ার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে জানানোর লক্ষ্যেই আমার আজকের এই ছোট লেখাটির অবতারনা।
পোল্ট্রি সায়েন্স বলছে পোল্ট্রি ফিডে কোনো গ্রোথ হরমোন ব্যবহার করা হয় না। গবেষকরা বলছেন, পোল্ট্রি’র সাথে আসলে হরমোন যায়-ই না। পোল্ট্রি সায়েন্স এতটাই অগ্রগতি লাভ করেছে যে উন্নতজাতের পোল্ট্রি মুরগিকে নির্দিষ্ট সময়ে পর্যাপ্ত ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ খাবার ও পরিচর্যা দিলে স্বাভাবিক নিয়মেই তার দ্রæত বৃদ্ধি ঘটে থাকে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের শরীরে যেমন হরমোন স্বাভাবিক নিয়মে তৈরি হয় ঠিক তেমনই জীবজন্তুর শরীরেও হরমোন তৈরি হয়। অনেকের মনে হতে পারে যে, ফিড এ্যাডেটিভ হিসেবে হয়ত গ্রোথ হরমোনের ব্যবহার থাকতে পারে, কিন্তু আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগেই এ্যাডেটিভ হরমোনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
‘পোল্ট্রি সায়েন্স’ নামক একটি সায়েন্টিফিক জার্নালে একাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ১৯৫৭ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত সময়ে ব্রয়লার মুরগির গ্রোথ প্রায় ৪০০ শতাংশ বেড়েছে। শুধু যে বেড়েছে তাই নয়, ফিড কনভারশন রেশিওতেও শতকরা প্রায় ৫০ ভাগ উন্নতি এসেছে। এই গবেষণায় বলা হয়েছে, ব্রয়লারের সাইজ বাড়ার পেছনে সিলেকটিভ ব্রিডিং ই মূলত: কার্যকর ভ‚মিকা পালন করে। ফিড কনভারশন রেশিও’র উন্নতির পেছনেও সেই একই কারণ দায়ি।
যুক্তরাষ্ট্রের আবার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের (Auburn University) অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ড. ওয়ালেস ডি. বেরি (Dr. Wallace D. Berry) বিস্তর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, পোল্ট্রিতে কোনো হরমোন ব্যবহারের সুযোগ নেই। ড. বেরি বলেছেন, গ্রোথ একটি জটিল প্রক্রিয়া এবং বাইরের গ্রোথ হরমোন মুরগির শারিরিক বৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারেনা। হরমোন বলতে সাধারণত গ্রোথ হরমোনকেই বোঝানো হয় যা মূলত: একটি প্রোটিন হরমোন। এটি মুখের মাধ্যমে দেয়া যায়না কারণ তাহলে সেটি স্বাভাবিক নিয়মে হজম হয়ে যাবে। তাই যদি’ একে কাজে লাগাতে হয় তবে তা ইনজেক্ট করতে হবে। সেক্ষেত্রে প্রতি ৯০ মিনিটে একবার এই ইনজেকশন পুশ করতে হবে!
ড. বেরি আরো বলেছেন, আলবামা রাজ্যে যদি ১১০-১২০ মিলিয়ন মুরগি থাকে এবং প্রতিটি মুরগিকে যদি প্রতি ৯০ মিনিট পরপর ইনজেকশন দিতে হয় তবে সেটি আসলেই কতটা বাস্তব-সম্মত কিংবা অর্থনৈতিক বিচারে যৌক্তিক তা যে কেউ খুব সহজেই বুঝতে পারবেন।
ড. বেরি’র এই সহজ ব্যাখ্যাটি যদি আমরা বুঝতে পারি তবে পোল্ট্রিতে গ্রোথ হরমোন নিয়ে নিশ্চয় আর কোন দ্বিধা-দ্ব›দ্ব থাকবে না। এ লেখাটি যারা পড়বেন তাঁদের হয়ত দ্বিতীয়বার এ নিয়ে প্রশ্ন করারও দরকার পড়বে না। তবে যাদের কাছে এ তথ্য নেই তাদের ক্ষেত্রে কী হবে?
উত্তরটা হচ্ছে তাঁদেরকেও জানাতে হবে, জানানোর জন্য পরিকল্পিত পরিকল্পনা নিতে হবে, এক্ষেত্রে সরকার এবং বেসরকারি উদ্যোক্তা উভয়কেই কাজ করতে হবে কারণ তথ্য না থাকলে বিভ্রান্তির সুযোগ রয়েই যাবে। সংবাদকর্মীদের জন্য চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে, তাঁদেরকে দুনিয়ার তাবদ বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করতে হয়। রাজধানী ভিত্তিক রিপোর্টারদের তাও অনেক ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট (এক বা একাধিক) বীট থাকে কিন্তু ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের ‘জুতা সেলাই থেকে চন্ডি পাঠ’ সবই করতে হয়। তাঁদের কাছে পোল্ট্রি বিষয়ক সংবাদের সোর্সের সংখ্যাও সীমিত। সরকারি অফিসে গেলে পোল্ট্রি নিয়ে কথা বলার মত কর্মকর্তাও অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায়না। আর সে কারণেই মাঠ থেকে আসা উড়ো সংবাদও অনেক সময় রিপোর্ট হয়ে যায়।