মাহফুজুর রহমান (চাঁদপুর প্রতিনিধি): চাঁদপুর নৌ-সীমানার পদ্মা-মেঘনা নদীতে ঝাঁকে-ঝাঁকে মা ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ছে এবং জেলেদের মাধ্যমে চাঁদপুরের মৎস্য আড়ৎগুলোতে আসছে। বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) সকাল থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একদিনে প্রায় ১০ হাজার মণ ইলিশ আমদানী হয়েছে বলে চাঁদপুর মৎস্য বনিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শবেবরাত কোম্পানী জানান। এর মধ্যে বেশীর ভাগই ডিমওয়ালা মা ইলিশ বলে ব্যবসায়ীরা জানান।
ইলিশ প্রজনন এর সময় হিসেবে মৎস্য অধিদপ্তর থেকে ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। সরকার এ ২২ দিন চাঁদপুর নৌ-সীমানার ষাটনল থেকে লক্ষীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার এলাকায় কোন প্রকার মাছ আহরন, ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন করা নিষিদ্ধ করা হয়। তারপরও জেলা টাস্কফোর্সের অভিযানের মধ্যে ও এ বছর অসাধু জেলেরা পদ্মা-মেঘনা নদীর মেঘনার পশ্চিম পাড়ের রাজরাজেশ্বর চর এলাকা ও শরীয়তপুর-চাঁদপুরের নৌ-সীমানার পদ্মা নদী থেকে শুরু করে সদর উপজেলার ইব্রাহীমপুর ইউনিয়নের চরফতেজংপুর, গুচ্ছগ্রাম চর, মেঘনা নদীর হরিনা, আনন্দ বাজার, কোড়ালিয়া নদীর পাড়, টিলাবাড়ি, আলুবাজার, ঈদগাহ বাজার, লক্ষ্মীরচর, সাখুয়া খাল, জাফরাবাদ, লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের রামদাসদী খাল, দোকানঘর, বহরিয়া, লোদেরপাড়, নন্দেশ খাঁর খাল, হানারচর ইউনিয়নের নন্দীর দোকান, গোবিন্দিয়া, চান্দ্রা ইউনিয়নের আখনের হাট, বাখরপুর গ্রামের নদীর পাড়, জ্বীন গাছতলা, তর পুরচন্ডী ইউনিয়নের আনন্দবাজার, কল্যাণপুর ইউনিয়নের নদীর পাড়সহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাবে অবাদে মা ইলিশ নিধন করে ইলিশের প্রজননে বাধা হয়ে দাড়ায় অসাধু জেলেরা।
তারা এ বছর প্রচুর পরিমাণে মা ইলিশ নিধন করেছে। তবে সরকার নির্ধারিত সময়েও ইলিশ ডিম ছাড়তে পারেনি বলে বর্তমান মাছ আহরন থেকে বুঝা যাচেছ। বিগত কয়েক বছর পূর্বে সরকার ইলিশ প্রজনন এর সময় হিসেবে ৭ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ১৫ দিন সময় নির্ধারণ করে দেয়। তখন দেখা যায়, এ নির্ধারিত ১৫ দিনে ও ‘মা’ ইলিশ পর্যাপ্ত ডিম ছাড়ছেনা।
সরকারের মৎস্য অধিদপ্তর পরবর্তীতে উচ্চ পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে ইলিশ প্রজনন এর সময় নির্ধারণ করেন ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর ২২ দিন। খবর নিয়ে জানা যায়, বিগত ৩ বছর যাবত এ ২২দিন ইলিশ প্রজনন সময় নির্ধারণ করার কার্যক্রম চলছে।
এ বছর দেখা যায়, ইলিশ প্রজননের সময় ২২দিনে চাঁদপুর নৌ-সীমানায় ব্যাপক ভাবে মা ইলিশ ডিম ছেড়ে মিঠা পানি থেকে লোনা পানিতে যাওয়ার পূর্বে অসাধু জেলেরা মা ইলিশ নিধন করে ইলিশ উৎপাদনে বেঘাত সৃস্টি করে। এতে ইলিশের বংশ বিস্তারে মারাত্বক বাধাগ্রস্থ হয়েছে।
সরকার ঘোষিত নির্ধারিত ২২ দিনে মা ইলিশ ডিম ছেড়ে শেষ করতে না পারায়, অভিযানের ২২ দিন পার হয়ে যাওয়ার ৪ দিন পর ২৬ দিনেও পদ্মা-মেঘনায় মা ইলিশ ধরা পড়ায় চাঁদপুরের প্রবীন মৎস্য ব্যবসায়ী ও মৎস্য নেতারা জানান, ইলিশ প্রজনন এর সময় সরকার আরো বৃদ্বি করা প্রয়োজন রয়েছে। কেননা ২২ দিনেও ইলিশ প্রজনন এর সময় ডিম ছেড়ে শেষ করতে পারেনি। এতে ইলিশের উৎপাদন দিন-দিন হ্রাস (কমে) পেয়ে ইলিশ আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে।
সরকার যে সময় নির্ধারণ করে দেয় তার মধ্যেও যেহেতু ইলিশ তার ডিম ছেড়ে শেষ করতে পারেনা।
এ জন্য সরকার আরো পর্যালোচনা করে ইলিশ প্রজনন এর সঠিক সময় নির্ধারণ করা প্রয়োজন বলে এখন অধিকাংশ ব্যবসায়ীইর ও দাবী। শুধু চাঁদপুর নৌ-সীমানায় মা ইলিশ পাওয়া যাচেছ, এটাই নয়। চাঁদপুর ছাড়া ও দক্ষিণ অঞ্চলীয় এলাকা থেকে যে সব ইলিশ চাঁদপুর আড়তে আসছে, তার অধিকাংশ ইলিশে ও ডিম রয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান।
সোমবার (২৯ অক্টোবার) থেকে বৃহস্পতিবার (১ নভেম্বর) পর্যন্ত চাঁদপুর শহরের বড় স্টেশন মৎস্য আড়ৎগুলোতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের সাথে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে যে ইলিশ আড়তে আসছে তার শতকরা ৬০ ভাগ ইলিশের পেটে ডিম রয়েছে। তবে চাঁদপুর নৌ-সীমানার পদ্মা-মেঘনা নদীতে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ছে। সব ইলিশের প্রতি মণ ৬০০ গ্রামের ২০ হাজার টাকা, প্রতি কেজি ৫২০টাকা, ৭০০গ্রামের ইলিশ প্রতি মণ ২২ হাজার থেকে ২৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি ৬৩০ টাকা, ৭/৮শ’ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচেছ প্রতি মণ ২৭ হাজার টাকা, প্রতি কেজি ৭০০টাকা।
১ কেজি ওজনের ইলিশ প্রতি মণ ৩২ হাজার টাকা, প্রতি কেজি ৮০০ টাকা থেকে ৮২০ টাকায় বিক্রি হচেছ। তবে বর্মমানে প্রচুর ইলিশ আমদানী হচেছ, ক্রেতাদেরকে তাদের ইচছা মত ইলিশ ক্রয় করতে দেখা যাচেছ।
অপর দিকে জেলে ও আড়ৎদাররা চাঁদপুর মাছ ঘাটের ৫০টির মত আড়তে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ নিয়ে আসছে। এতে করে মাছঘাট ও আড়ৎ সরগরম হয়ে উঠেছে। ক্রেতারা জানান, বিগত বছর এ ধরনের দামে ক্রেতারা ইলিশ ক্রয় করেনি। যার ফলে চাঁদপুর মাছ ঘাটে চাঁদপুরসহ বিভিন্ন স্থানের মানুষ এসে ভিড় করতে লক্ষ্য করা যাচেছ। বিভিন্ন মহলের মতে একদিকে জেলেরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ২২দিনেও অবিচারে মা’ ইলিশ নিধন করেছে।
অপর দিকে নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়ে ৪ দিন অতিবাহিত হলেও ইলিশের পেটে প্রচুর পরিমাণে ডিম পাওয়া যাচেছ। তাতে করে বুঝা যাচেছ, ইলিশ সরকার ঘোষিত নির্ধারিত সময়েও ডিম ছাড়েনি। এর পর জড়িপ করে ও চাঁদপুরে প্রজনন এর সময় জেলা টাস্কফোর্স যে পরিমাণ জেলে আটক, কারেন্টজাল ও ইলিশ জব্দ করেছে, তাতে করে দেখা যায়, অবাধে মা ইলিশ নিধন হওয়ায় এবার ইলিশ উৎপাদন বাধাগ্রস্থ হবে এবং ইলিশ উৎপাদন এ বছর তার লক্ষ্য মাত্রায় পৌছতে পারবেনা। তার মধ্যে এবার জাটকা মৌসুমে জাটকা রক্ষা না হয়ে জাটকা নিধন হলে ইলিশ উৎপাদন বিগত বছরের তুলনায় অনেকগুণ হ্রাস পাওয়া সম্বাবনা রয়েছে বলে ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে প্রবীন ইলিশ ব্যবসায়ী মো. সিরাজ চোকদার জানান, আমার ব্যবসায়ী বয়সে চাঁদপুর নদীতে এত ইলিশ নিধন হতে দেখিনি। তবে যে পরিমাণ ইলিশ এ বছর পদ্মা ও মেঘনায় ডিম ছাড়তে এসেছে, সে ইলিশ ডিম চাড়ায় বাধাগ্রস্থ না হলে এ বছর ইলিশ প্রচুর উৎপাদন হতো, এবং এ ইলিশ মানুষ কম দামে খেতে পারতো। মা ইলিশ ডিম ছাড়ার সময় সঠিক হয়নি। সরকারের ২২ দিন নিষেধাজ্ঞার পর ও মা ইলিশ পাওয়া যাচেছ, তাতে মনে হচেছ,সময় আরো বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।
এ ব্যাপারে চাঁদপুর মৎস্য বনিক সমিতির সভাপতি আবদুল খালেক মাল জানান, এ বছর অবৈধ ভাবে প্রচুর মা ইলিশ নিধন হয়েছে, প্রশাসনের অভিযান থেকে বুঝা যায়। ‘মা’ ইলিশ লোনা পানির ও গভীর জলের মাছ। এ মা ইলিশ ডিম ছাড়ার পূর্বেই ধরা পড়ে যাওয়ায় ডিম ছাড়তে পারেনি। এতে করে ইলিশ উৎপাদন আগামীতে কম হওয়ায় সম্বাবনা রয়েছে। তবে এখন ও মা ইলিশ প্রচুর পাওয়া যাচেছ। তাতে করে আমার ধারণা ইলিশ ডিম ছাড়ার সময় পায়নি। এতে করে ইলিশের প্রজনন সময় আরো বৃদ্বি করা প্রয়োজন, বলে আমি সরকারের দৃস্টি আকর্ষণ করছি।
এ ব্যাপারে চাঁদপুর মৎস্য আড়তের প্রবীন ব্যবসায়ী জালাল উদ্দিন জমাদার বাবুল হাজী বলেন, এ বছর প্রচুর মা ইলিশ নিধন হয়েছে। এসব ইলিশ ডিম ছাড়তে পারলে মাছে-পানিতে সমান হয়ে যেতো। এতে করে ইলিশে পোনা জাটকা উৎপাদন কম হবে। সে জাটকা যদি সঠিক ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না হয় তবে ইলিশ উৎপাদন কম হবে বলে ধারনা করছি। এখন যে পরিমাণ ইলিশ আমদানী হচেছ, তার মধ্যে প্রচুর মা’ইলিশ রয়েছে। ইলিশ ডিম ছাড়ার সময় পায়নি। তবে সরকার এ বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা প্রয়োজন রয়েছে। ইলিশের প্রজনন সময় আরো বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করছি।