মো. খোরশেদ আলম জুয়েল : বিশ্বব্যাপী মাংস উৎপাদনে পোলট্রি একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং দ্রুত বর্ধনশীল উপাদান। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও পুষ্টি বিবেচনায় পোলট্রি মাংস ও ডিমের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সাথে বাড়ছে উৎপাদন। দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে এ খাতের উদ্যোক্তারা এখন বিশ্ববাজারে পোলট্রি পণ্য প্রবেশের জন্য প্রস্তুত। বাড়ছে পোলট্রি ফার্মিং, কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ এবং প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের মাত্রা। ভোক্তাদের ক্রমবর্ধমান আয় বৃদ্ধি, আধুনিক উপায়ে পোলট্রি ফার্মিং, পুষ্টি সচেতনতা, পোলট্রি শিল্পের সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়, উৎপাদন কৌশল এবং বাজারজাত ব্যবস্থার উন্নয়ন বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্প সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প জিডিপিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। বেকারত্ব নিরসন ও নারীদের স্বাবলম্বী করার অন্যতম এক হাতিয়ার এখন পোলট্রি পালন। পোলট্রি শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এখন ইমার্জিং টাইগার এবং দেশ গঠনে নীরব বিপ্লবের গর্বিত অংশীদার।
প্রোটিন চাহিদা, উৎপাদন, গ্রহণ এবং অন্যান্য দেশের তুলনামূলক চিত্র
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) -এর গাইড লাইন অনুযায়ী মানব দেহ শক্তির ৬০ শতাংশ আসা উচিত শস্য জাতীয় পণ্য যেমন- চাল, গম, ডাল, ভুট্টা প্রভৃতি থেকে এবং ১০-১৫ শতাংশ আসা উচিত আমিষ থেকে। আবার এই আমিষের কমপক্ষে ২০ শতাংশ আসতে হবে প্রাণিজ আমিষ থেকে। যদিও উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই এ আমিষের ৫০ শতাংশই আসে প্রাণিজ আমিষ থেকে। এটি নির্ভর করে মানুষের আয়, পুষ্টি সচেতনতা, খাদ্যাভ্যাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ওপর। এফএও তথ্যমতে, একজন মানুষের সামগ্রিক দৈনিক আমিষ গ্রহণের কমপক্ষে ১৫ গ্রাম আসা উচিত প্রাণিজ আমিষ থেকে। যদিও সংস্থাটির ২০১৫ সনে করা হিসেবে মতে বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ ডিম থেকে গড়ে ১ গ্রাম ও পোলট্রি মাংস থেকে আসে ৩ গ্রাম অর্থাৎ সর্বমোট ৪ গ্রাম। বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটি (BPICC) -এর ২০১৫ সনের তথ্য মতে, বাংলাদেশের মানুষ মাথাপিছু বার্ষিক গড়ে ৪৫-৫০টি ডিম এবং ৩.৬৩ কেজি পোলট্রি মাংস গ্রহণ করতেন। বিপিআইসিসির ওয়েবসাইটে দেয়া সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বর্তমানে দেশের মানুষ গড়ে প্রতি বছরে ৫ কেজি ব্রয়লা মুরগির মাংস (অন্যান্যসহ ৬.৩ কেজি) এবং ৭৬টি ডিম ভোগ করেন।
১৯৭৭ সনে বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য তালিকার প্রাণিজ আমিষের ১৪% আসতো পোলট্রি থেকে যা ১৯৮৭ সনে এসে উন্নীত হয় ২৩% (আলম ১৯৯৭)। দামের স্বল্পতা, উত্তরোত্তর উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে এক্ষেত্রে প্রাণিজ আমিষের কমপক্ষে ৫০% দখল করার সুযোগ রয়েছে পোলট্রিজাত পণ্য থেকে। সূক্ষ্মভাবে হিসেবে করলে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে পোলট্রি ও ডিমের উৎপাদন ব্যাপক বেড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। তবে আমাদের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর প্রয়োজনীয় প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের মাত্রা এখনো বেশ পিছিয়ে আছে। আবার সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর বিশাল একটি অংশ যারা দরিদ্র তাদের প্রয়োজনীয় আমিষ গ্রহণের মাত্রা আরো অনেক কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা -এর যৌথ সমীক্ষা অনুযায়ী, সুস্থ থাকার জন্য একজন মানুষকে বছরে অন্তত ৪৩.৮০ কেজি প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) -এর পরামর্শ মতে বার্ষিক ডিম গ্রহণের পরিমাণ হওয়া উচিত জনপ্রতি বছরে সর্বনিম্ন ১০৪টি। বাংলাদেশের মানুষ খায় বার্ষিক জনপ্রতি ৭২টি। উল্লেখ্য, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডিম খায় জাপানিরা যাদের বার্ষিক জনপ্রতি ডিম খাওয়ার পরিমাণ ৬০০টি। বিপিআইসিসি বলছে, তাঁরা দেশের মানুষকে ২০২১ সনের মধ্যে বার্ষিক জনপ্রতি পোলট্রি মাংস ৭ কেজি এবং ১০৪টি ডিম খাওয়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে।
দ্যা পোলট্রি সাইট ডট কম -এর ২০১৫ সনে করা এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্ব জনসংখ্যার বার্ষিক সামগ্রিক মাংস গ্রহণের পরিমাণ জনপ্রতি ৪১.৩ কেজি যা ২০৩০ সনে উন্নীত হবে ৪৫.৩ কেজিতে। এর মধ্যে বার্ষিক পোলট্রি মাংস গ্রহণের পরিমাণ ১৩.৮ কেজি যা ২০৩০ সনের মধ্যে উন্নীত হবে ১৭.২ কেজিতে হবে ধারনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, ২০৩০ সনের মধ্যে সামগ্রিক মাংস উৎপাদনের ৩৮% থাকবে পোলট্রির দখলে বর্তমানে যার পরিমাণ ৩৩%। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সে সময় পোলট্রি মাংস গ্রহণের পরিমাণ জনপ্রতি বর্তমানের ১০.৫ কেজি থেকে উন্নীত হয়ে ১৪ কেজি পৌঁছবে বলে বিশেষজ্ঞদের পূর্বাভাস।
পোলট্রি ফার্ম ও হ্যাচারি
বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটির তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৬৫-৭০ হাজার পোলট্রি ফার্ম রয়েছে। ১৯৯৩-৯৪ সনে পোলট্রি ফার্মের সংখ্যা ছিল ৪৩, ৫৮৯ টি যা ২০০৬-০৭ এ বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় প্রায় ১,৫০,০০০ [Source: Fattah (2000) and IFC (2007)]। বর্তমানে দেশে ৮টি কোম্পানির মোট ১৫টি জিপি (গ্র্যান্ড প্যারেন্ট ফার্ম রয়েছে), বড় ছোট মিলিয়ে মোট ২০৫টি প্যারেন্ট স্টক ফার্ম রয়েছে।
২০০৭ সনের ২২ মার্চ তারিখে সাভারস্থ বিমান পোলট্রি কমপ্লেক্সে বাংলাদেশে প্রথম এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা শনাক্ত হয়। এরপর ২০০৯ এবং ২০১১ সনে সারাদেশে ব্যাপক হারে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রমণ হয় এবং হাজার হাজার ছোট খামারি পথে বসে যায়। জুলাই ২০১২ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৪ পর্যন্ত রোগটির বিস্তার রোধ এবং জনস্বাস্থ্য হুমকি বিবেচনায় আক্রান্ত খামার হতে ১,৫১,০৭৫টি মুরগি ও ৩,৪৯,৫৫২টি ডিম ধ্বংস করা হয় বলে বিবিএস ২০১৪ রিপোর্ট হতে জানা যায়। এছাড়াও বিগত প্রায় এক বছর ধরে ডিমের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণেও অনেক ছোট খামারি ধ্বংস হয়ে গেছে। সময় সময় সেক্টরটিতে নানা ঘাত সহ্য করে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটির দাবী, দেশে ছোট খামারির সংখ্যা কমলেও সামগ্রিক পোলট্রি পপুলেশনের সংখ্যা বেড়েছে। যার সত্যতা পাওয়া যায় বিভিন্ন সংস্থার করা উৎপাদন ও ভোগের চিত্র দেখলে।
বিপিআইসিসির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট বড় হ্যাচারিগুলোতে সপ্তাহে ১.৫৫ থেকে ১.৬ কোটি ব্রয়লার বাচ্চা, ১৬ লাখ লেয়ার (সব ধরনের) বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে। ২০১৫ সনে প্রতি সপ্তাহে গড়ে প্রায় ৮০-৯০ লাখ ব্রয়লার বাচ্চা ও প্রায় ৪-৫ লাখ লেয়ার বাচ্চা উৎপন্ন হতো। এছাড়াও এসব ছোট বড় ফার্ম হতে দেশে প্রতিদিন ডিম উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৩.৮ কোটি যা ২০১৫ সনে ছিল দুই থেকে সোয়া দুই কোটি। ব্রয়লার, সোনালী এবং কক মিলিয়ে প্রতিদিন মাংস উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৪০০ মেট্রিক টন। তবে বিগত প্রায় এক বছর ডিমের দাম টানা কমে যাওয়ায় ছোট এবং মাঝারি অনেক ফার্ম বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ডিমের প্রকৃত উৎপাদন আরো কম হতে পারে অনেক উদ্যোক্তার সাথে কথা বলে জানা গেছে।
অর্থনৈতিক উন্নয়নে পোলট্রি
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পোলট্রি শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সহজলভ্য প্রোটিনের উৎস, তুলনামূলক কম দাম এবং মানুষের আয় বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা কারণে ভবিষ্যতে পোলট্রির চাহিদা আরো বাড়বে। বিপিআইসিসির দেয়া তথ্যমতে বর্তমানে দেশের জিডিপিতে পোলট্রি খাতের অবদান ১.৫-১.৬ ভাগ। বিপিআইসিসির রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০২৫ সনের মধ্যে জিডিপিতে ৪-৫% অবদান রাখতে চায় শিল্পটি। পোলট্রি শিল্পে বর্তমান বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। কয়েক বছর আগেও যার পরিমাণ ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা।
এফএও তথ্যমতে, আশি ও নব্বই দশকজুড়ে যথাক্রমে পোলট্রির বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৪.৩ এবং ৩.৪ শতাংশ হারে, আবার মোট মাংসের বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার সে সময় যথাক্রমে ৩.৯ এবং ৩.৪ শতাংশ হারে। বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, নব্বই দশকের একেবারে শেষের দিকে নিজেদের একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়। পোলট্রি শিল্পের বর্তমান বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার প্রায় ১৫-১৮%; তবে ১৯৮০ থেকে ২০০৭ সন পর্যন্ত আগে এ হার ছিল প্রায় ২০% (বিপিআইসিসি)। মাঝে ১৯৯১-৯৭ সনে বাংলাদেশে পোলট্রি গড় বৃদ্ধির হার ছিল ৬.৭% (আলম, ১৯৯৭)। ২০০৭ সনে স্বল্প পরিসরে এবং ২০০৯ ও ২০১১ সনে ব্যাপকভাবে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রমণের কারণে গড় বৃদ্ধির হার কমে যায় (বিপিআইসিসি)। বছরখানেক ধরে পোলট্রি শিল্পে মন্দা বিরাজ করায় প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমেছে। তবে সংস্থাটির দাবি গড় বৃদ্ধির হার কমলেও সার্বিক পোলট্রি উৎপাদন বেড়েছে এবং অচিরেই গড় বৃদ্ধির আগের অবস্থানকে টপকে যাবে। তাদের দাবী সরকারি সহযোগিতা পেলে ২০২১ সনের মধ্যে পোলট্রি শিল্পের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ বর্তমানের দ্বিগুণ ছাড়িযে যেতে পারবে যার পরিমাণ হবে প্রায় ৬৩ হাজার কোটি টাকা হবে। উল্লেখ্য যে, আশির দশকে এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫শ কোটি টাকা। এছাড়াও ২০২১ সনের মধ্যে সপ্তাহে ২.৫ কোটি একদিন বয়সী কমার্শিয়াল বাচ্চা, বছরে ১৫শ কোটি ডিম, ২০ লাখ মেট্রিক টন মুরগির মাংস এবং ৮০ লাখ মেট্রিক টন ফিড উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে সংস্থাটি।
বিপিআইসিসির হিসাব মতে দেশে বর্তমানে ডিমের বাণিজ্যিক উৎপাদন দৈনিক প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী বাণিজ্যিক উৎপাদন এবং গৃহপালিত মুরগি, হাঁস ও কোয়েল পাখির ডিম হিসাব করলে দৈনিক গড় উৎপাদন ৪ কোটি ৭১ লাখের ওপরে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ডিম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১,৬৬৫ কোটি পিস। এর মধ্যে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর -এই তিন মাসে ডিমের মোট উৎপাদন হয়েছে ৪৩৩.৫৩ কোটি পিস। প্রতিটি ডিমের গড় মূল্য ৭ টাকা ধরা হলে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে প্রায় ৮,৩৩৮.৬৮ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রায় ১০,৪৫২.১২ কোটি টাকার ডিম কেন্দ্রিক বাণিজ্য হয়েছে। চলতি অর্থবছরে প্রায় ১১,৬৫৫ কোটি টাকারও অধিক ডিম কেন্দ্রিক বাণিজ্য হবে বলে সংগঠনটি আশা প্রকাশ করেছে।
রপ্তানি সম্ভাবনায় পোলট্রি
এক সময় বাংলাদেশে পোলট্রি প্যাকেটজাত মাংস ও ডিম ছিল আমদানি নির্ভর। আমদানি নির্ভরতা কাটিয়ে বাংলাদেশ এখন নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে ডিম ও মাংস রপ্তানির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। অবশ্য ২০০৭ সনের আগে সীমিত পর্যায়ে কয়েকটি দেশে একদিন বয়সী বাচ্চা (DOC) রপ্তানি শুরু করেছিল বাংলাদেশ। নেপালে একদিন বয়সী বাচ্চা রপ্তানিও হয়েছিল তখন। কিন্তু ২০০৭ সনের এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা আক্রান্ত হওয়ার পর সে রপ্তানি থমকে যায়। এছাড়াও পোলট্রি বলতে শুধু সরাসরি ডিম ও মাংস খাওয়ার ধারণা থেকেও সরে আসতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। পোলট্রি মাংস দিয়ে বিভিন্ন রকমের সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার যেমন- নাগেটস, চিকেন বল, বার্গার, চিকেন স্ট্রিপস সহ প্রায় ৪০-৫০ রকমের বিভিন্ন আইটেম তৈরি করে বাজারজাত শুরু করেছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে ডিম ও মাংসজাত এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানির জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়। তবে বাংলাদেশ পোলট্রি মাংস রপ্তানির ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইউরোপীয়ান মার্কেটে নিজেদের অবস্থান করে নিতে এন্টিবায়োটিকের সতর্ক ব্যবহার ও পোল্ট্রি খাদ্যে মিট অ্যান্ড বোন মিল ব্যবহার রোধ করতে হবে এ শিল্পের সাথে জড়িত বিশেষজ্ঞদের মতো। বাংলাদেশ সরকার এ দুটি উপাদান আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, ডিম ও মাংস নিরাপদ হতে হবে। ইতিমধ্যে এসব কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।
কর্মসংস্থান
গার্মেন্টস শিল্পের পর এদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে পোলট্রি শিল্প। বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে রেখেছে উল্লেখযোগ্য অবদান। পড়ালেখা শেষ করে চাকুরিই করতে হবে এমন ধারণা থেকে দেশের অনেক শিক্ষিত যুবকই সরে এসেছেন এবং পোলট্রি ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেছেন। কর্মঠ বেকার যুবকদের বিদেশবিমুখ করার ক্ষেত্রেও রেখেছে অনন্য অবদান। গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে রেখে চলেছে বলিষ্ঠ অবদান। বর্তমানে পোল্ট্রি শিল্পে ২০ লাখ মানুষের স্ব-নিয়োজন কর্মসংস্থান হয়েছে এবং এই শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা পেলে আগামী ২০২৫ সনের মধ্যে এ শিল্পে প্রায় এক কোটি মানুষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবেন বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
দরিদ্রতা নিরসন
বিগত প্রায় দেড় দশক ধরেই বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্পের দ্রুত বিকাশ চোখে পড়ার মতো। সার্বিক কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে কৃষির এ উপখাতটির অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের একটি আকর্ষণীয় মাধ্যম এটি; বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের নারীদের দরিদ্রতা নিরসনের ক্ষেত্রে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং দক্ষতা অর্জনে ভূমিহীন, অনগ্রসর, প্রথাগত শিক্ষাবর্জিত জনসংখ্যাকে একত্রিত করার মাধ্যমে শিল্পটি দরিদ্রতা নিরসনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। দারিদ্রতা নিরসনের গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে পোলট্রি শিল্প শুধু এসব ধরনের মানুষের জন্যই নয়; দুস্থ নারীদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রেও একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। অন্যান্য শিল্পের সাথে পোলট্রির একটি পার্থক্য হলো- অল্প মুলধন, সীমিত জায়গা নিয়ে সহজেই একজন এ ব্যবসা শুরু করতে পারেন। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বৃহৎ একটি অংশ সরাসরি এ শিল্পের সাথে জড়িত হওয়ার কারণে তাদের বেশিরভাগেরই জীবনে দরিদ্র এখন কেবল একটি অতীত ইতিহাস। দরিদ্রতা নিরসনে পোলট্রি পালন সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কারণে এ শিল্পটি দ্রুত বিস্তৃত হতে পেরেছে।
ফিড মিল ও সহযোগী শিল্প গঠন
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (FIAB) -এর ২০১৩ সনের এক প্রতিবেদন হতে জানা যায়, দেশে পোল্ট্রি ফিডের বাৎসরিক চাহিদা ছিল সে সময় ২.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন। বিপিআইসিসি’র তথ্যমতে, ২০১৭ সনে বাংলাদেশে ফিড উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫.৬ মিলিয়ন মেট্রিকটন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর (DLS)-এর তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত ফিডমিলের সংখ্যা ১৫০টি এবং অনিবন্ধিত ফিডমিল রয়েছে ১২৮টি। এছাড়াও গড়ে উঠেছে ওষুধ শিল্প, রয়েছে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহকারী। বর্তমানে (প্রাণি স্বাস্থ্যসেবায় ওষুধ ও প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহকারী) ৪০৪টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে (সূত্র: আহ্কাব)। এদের মাধ্যমেও হাজার হাজার লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে।
পোলট্রি বা মুরগির ৬০-৭০ শতাংশই খরচ হয় ফিড বা খাদ্য বাবদ। আবার সে খাদ্য তৈরি প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৫৫-৬৫ শতাংশই ভুট্টার ব্যবহার। ফলে দেশে এখন ব্যাপক হারে বিশেষ করে চরাঞ্চলে ভুট্টার আবাদ বাড়ছে। এক সময় এ ভুট্টা প্রায় সম্পূর্ণটাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। বর্তমানে বাংলাদেশের ফিডমিলগুলোর প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশই দেশীয় উৎপাদিত ভুট্টা ব্যবহার করছে। এর ফলে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে অন্যদিকে অনাবাদি জমি চাষের আওতায় আসছে। ফলে একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে, বাড়ছে অর্থনীতির চাকার ঘূর্ণন। পোলট্রি শিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি হচ্ছে বায়োগ্যাস, বিদ্যুৎ ও সার। বেশ কয়েকটি কোম্পানি নিজেদের খামারের চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ এখন সেখান থেকেই উৎপন্ন করছে। পোলট্রি লিটার থেকে তৈরি হচ্ছে জৈব সার। এছাড়াও এ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ, ভ্যাকসিন, যন্ত্রপাতির, প্যাকেজিং ব্যবসা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে। বাড়ছে সামগ্রিক বিনিয়োগের পরিমাণ।
সমাপনী
বাংলাদেশ পোলট্রি শিল্পের নীরব বিপ্লবের ইতিহাস ততটা মসৃন নয়। রোগবালাইয়ের ধকল, মাঝে মধ্যে রাজনৈতিক অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের জন্য শিল্পটিকে হোচট খেতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। বিগত বছরগুলোতে এমনকি ২০১৪-১৫ অর্থবছরেও পোলট্রি করমুক্ত খাত হিসেবে সুবিধা পেয়েছে। কিন্তু ২০১৫-১৬ অর্ধবছরের সর্বশেষ বাজেটে শিল্পটির ওপর কর আরোপ করা হয়। এছাড়াও এআইটি (এডভান্স ইনকাম ট্যাক্স), আমদানি শুল্ক ও ইত্যাদির ঝামেলাতো রয়েছেই। আবার পোলট্রি কৃষির একটি উপখাত হলেও ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে শিল্পটি কৃষি খাতের সুবিধা পায়না। ঝুঁকিপূর্ণ শিল্প হিসেবে দেশের ব্যাংকগুলো প্রয়োজনীয় ঋণ দিতে তেমন আগ্রহী নন। এসব নানা কারণে বাড়তি চাপ পড়েছে শিল্পটির ওপর।
ডিম ও ব্রয়লার মাংস সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অনেকেরই সঠিক ধারণার অভাব রয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই মনে করেন মুরগির ফিডে ক্ষতিকারক হরমোন ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ধারণাটি সম্পূর্ণই ভুল। জেনেটিক্যালী ইমপ্রুভড বার্ডকে সঠিক ও পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করলে মুরগির স্বাভাবিক বৃদ্ধি এমনিতেই সম্ভব। আবার অনেকেই মনে করেন ডিম ও ব্রয়লার মাংস উৎপাদনে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার করা হয়। অথচ বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই সেটি নিষিদ্ধ করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে যে সেটি একেবারেই হচ্ছে না তা নয়, তবে সেটি মুরগির রোগ হলে এবং সেটি অবশ্যই অভিজ্ঞ ভেটেনারিয়ানদের পরামর্শ মোতাবেক। এক্ষেত্রে জনসাধারণকে পোলট্রি সম্পর্কে আরো বেশি শিক্ষিত ও সচেতন করা উচিত প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং এ ব্যবসার সাথে জড়িত উদ্যোক্তা ও সংগঠনগুলোর। পাশাপাশি যারা অসাধুতার আশ্রয় নিচেছ তাদেরকে প্রতিহত করতে হবে। পোলট্রি শিল্পে নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে ইতোমধ্যে এখন সেই বিপ্লবটিকে টেকসই ও স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সকলের।