অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সামছুদ্দোহা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক। এছাড়া পোলট্রি ও ডেইরি শিল্পে বাংলাদেশের সুবৃহৎ কোম্পানি নাহার এগ্রো গ্রুপ -এর চেয়ারম্যান। প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যবহারিক উভয় দিক থেকেই উল্লেখিত দুটি শিল্পে তিনি অভিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। দেশের কৃষি সেক্টরে একটি কথা মাঝেমাঝেই ঘুরে ফিরে আলোচনায় আসে এবং সেটি হলো কৃষক বা খামারি তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন। এক্ষেত্রে প্রচলিত বাজার ব্যবস্থাপনায় অনেক ক্রুটি বিচ্যুতি রয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। ড. দোহা যেহেতু মার্কেটিং বিভাগের একজন অধ্যাপক এবং পাশাপাশি উল্লেখিত ব্যবসার সাথে সরাসরি জড়িত, তাই আমরা চেষ্টা করেছি পোলট্রি ও ডেইরি শিল্পে বিরাজমান পরিস্থিতি, বাজার ব্যবস্থাপনার ত্রুটি, উত্তরণ এবং উন্নীতকরণের কৌশল সম্পর্কে জানার। সেই জানার চুম্বক অংশ সম্মানিত পাঠকদের উদ্দেশ্যে এখানে প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এগ্রিনিউজ২৪.কম এর সম্পাদক ও প্রধান নির্বাহী মো. খোরশেদ আলম জুয়েল, শ্রুতিলিখনে ছিলেন সহ সম্পাদক মো. জহিরুল ইসলাম সোহেল।
অধ্যাপক ড. দোহা: সেই ১৯৮৬ সালের কথা। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। বাবা তখন রেলওয়েতে চাকরি করতেন। উনার স্বপ্ন ছিলো এবং সবসময় বলতেন রিটায়ার্ড করার পর গ্রামে গিয়ে একটা খামারবাড়ী করবেন। সেখানে পুকুরে মাছ, খামারে হাঁস, মুরগি, গরু সব থাকবে। বাবার স্বপ্ন, উৎসাহ আর অনুপ্রেরণায় তখন থেকেই বড় ভাই (রকিবুর রহমান টুটুল, এমডি, নাহার এগ্রো) আর আমার পোল্ট্রিতে হাতেখড়ি। আমরা সরকারি যে বাসায় থাকতাম সেখানে অনেক খোলা জায়গা ছিলো। সেখানেই ৫০টা লেয়ার মুরগি দিয়ে অনেকটা আমরা প্রথমে শুরু করি। আসলে তখনতো আর সেভাবে ব্যবসা বুঝতাম না। শখ করেই সবাই মিলে করা। বড় ভাই সেই থেকেই ব্যবসায়ী হবেই বলে ব্রত ছিল। মা এবং আমরা তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতাম। আমাদের ঘরে দৈনিক তখন ৮-১০টা ডিম লাগতো। তখন নিজেরা খাওয়ার জন্য ডিম রেখে অতিরিক্ত ডিমগুলো বাজারে বিক্রি করে দিতাম। আমাদের যাত্রা শুরু মূলত এভাবেই।
এরপর পোলট্রির একদিনের বাচ্চা ও ফিডের পরিবেশক হিসেবে ব্যবসা করেছি দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলোর সাথে। পরিবেশক ব্যবসার পাশাপাশি নিজেদের বেশ কিছু খামার হয়ে যায়। তাই ব্যবসার পাশাপাশি আমরা চাকতাই, খাতুনগঞ্জ, পাহাড়তলী থেকে ফিডের কাঁচামাল এনে ফিড ফর্মুলেশন করে নিজেরাই ফিড তৈরি এবং মুরগিকে খাওয়ানো শুরু করি। বাড়তে থাকে ব্যবসার পরিধি। এরপর আস্তে আস্তে নিজেরাই হ্যাচারি, ফিডমিল প্রতিষ্ঠা শুরু করি। পাশাপাশি আমি লেখাপড়া করতে থাকি। HSBC, Grameen সহ বেশ কয়েকটা কোম্পানিতে চাকুরী করে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেই। ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়া থেকে পিএইচডি করি আর সেটাও পোল্ট্রি সাপ্লাই চেইনের উপরে। যখনি সময় পেয়েছি, বড় ভাইকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি।
ঐদিকে, ডেইরিতে যদি শুরুর কথা বলি তবে বলতে হবে ১৯৮৯ সনের কথা। ওতটা বাণিজ্যিক চিন্তা করে নয়, মাত্র ৩টা গরু নিয়ে যাত্রা শুরু করি নিজেদের দুধের চাহিদার মেটানোর জন্য। বাকীটুকু বিক্রি করে দিতাম। আসলে আমরা খুব ধীরে ধীরে এগিয়েছি। হাটি হাটি পা পা করে এতোদূর আসা। এখনতো অনেককেই বলতে শুনি ক্যাটল শিল্পে নাকি আমরাই সবচেয়ে এগিয়ে আছি। সেটা একদিনে হয়নি। অনেকের অনেক শ্রম আছে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ধীরে ধীরে এই পর্যায়ে নিয়ে আসতে। সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: নাহার এগ্রো প্রতিষ্ঠার পেছনে আপনার মায়ের ভূমিকা অনেক বলে আমরা শুনেছি, এ ব্যাপারে কিছু বলবেন?
অধ্যাপক ড. দোহা: হ্যা, আপনি ঠিকই শুনেছেন। এই যে আমাদের এতোদুর আসা, এর পিছনে আমাদের মায়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। উনি না থাকলে হয়তো আজ আমাদের এতোদুর আসা সম্ভব হতো না। আমার বাবা হেল্পফুল না হলে এই ব্যাবসার শুরুই হতো না। অনেক বাবা-মা ছেলেদের লেখাপড়ার ক্ষতি চিন্তা করে রাজী হতো না। তিনি সেই ঝুঁকি নিয়েছিলেন আর ছেলেদের উপর আস্থা রেখেছেন বলেই আজ এতোখানি হয়েছে আল্লাহ্র অশেষ কৃপায়। ভালো মানুষ বেশিদিন বাঁচেনা এবং সেটাই সত্যি হলো। ১৯৯৪ সনে আমাদের বাবা মারা যান। তখন আমি মাত্র এইচ.এস.সি দিয়েছি, বড় ভাই তখন ডিগ্রিতে পড়েন। তখন মা-ই আমাদের আগলে রেখেছেন। তখন থেকে আজ অবধি মা আমাদেরকে ছায়ার মতো দেখে রেখেছেন।
আসলে বাবা ছিলেন আমাদের স্বপ্নদ্রষ্টা, আমার মা হলেন সেই স্বপ্নের বাস্তব রুপকার। সাথে বড় ভাই ছিলেন, উনি প্লান দিতেন আমি সার্পোট করতাম। আমরা পড়ালেখার ফাঁকে যতটুকু সময় পেতাম সব সময়টুকুই আমাদের খামারে ব্যয় করতাম। মা আমাদের হাতে কলমে শিক্ষা দিয়েছেন। উনি তখন নিজেই খামারে কাজ করতেন। এমনও সময় ছিলো রাত ২টা বা ৩টা বাজে মা খামারে চলে যেতেন। দেখতেন খামারে ঠিকমতো পানি-খাদ্য দেয়া হয়েছে কিনা বা কোনো হিংস্র পশু খামারে আক্রমণ করলো কিনা। এখনো তিনি কাছাকাছি যে খামারগুলো আছে সেখানে চলে যান খোজখবর নেয়ার জন্য।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: দেশের পোলট্রি শিল্পে টানা এক বছর ধরে একটা অস্থির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর প্রধান কারণ কি বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক ড. দোহা:: এই শিল্পে সাপ্লাই চেইনে একটা বড় সমস্যা আছে আমাদের। বিজনেসের ক্ষেত্রে সাপ্লাই চেইন একটা বড় ইস্যু। আমাদের মধ্যে নিবিড় একতা নেই বলে আমি মনে করি। আমরা যে যার যার মতো ব্যবসা করছি। আমাদেরকে ভাবতে হবে সারা বাংলাদেশে প্রতিদিন/সপ্তাহে/মাসে/বছরে ডিম ও মাংসের চাহিদা কত? চাহিদার প্রবৃদ্ধির হার কত? জনসংখ্যার সাথে সাথে পরের বছর কতো হতে পারে, আরো পাঁচ বছর কতো হবে ইত্যাদি এবং সেই অনুযায়ী উৎপাদন ও সরবরাহ করতে হবে। কারণ, সা্প্লাইয়ের সাথে ফুড কনজামশনটা ঠিক থাকতে হবে। তাহলেই সাপ্লাই আর ডিমান্ড -এর মধ্যে সমন্বয় হবে। আর তা না হলে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এবং হবো। তাছাড়া ভোক্তাদের প্রতিদিন মিনিমাম প্রোটিন ইনটেক সম্বন্ধে ধারনা দিতে হবে। প্রোটিনের অন্যান্য সোর্স কি হতে পারে সেগুলোর কমপ্লিট ইনফরমেশন দিতে হবে। তাহলে ভোক্তারা নিজেরাই নিজেদের ভালোর জন্য সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। পুশ মার্কেটিং করে মার্কেট বেশীদিন টিকানো যায় না। ভোক্তাকে তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহজ করে বুঝাতে হবে।
আরো একটি বিষয় খেয়াল করুন, দেশের এখন কয়েকশ’ ফিডমিল রয়েছে। প্রতিদিন শুনবেন অমুক জায়গায় নতুন ফিডিমিল হচ্ছে। বুঝে হোক কিংবা না বুঝে লাভের কথা শুনেই অনেকে দৌড়াচেছ। কিন্তু এতোগুলো ফিডমিল আদৌ দরকার আছে কিনা সেটাওতো দেখার বিষয়। কারণ, চাহিদার সাথে উৎপাদনের তো একটা সমন্বয় থাকতে হবে। সমন্বয় না থাকলে তো আমরা সবাই ক্ষতির সম্মুখীন হবো। সেজন্য কিছু করার আগে ফিজিবিলিটি স্টাডি করার দরকার।
আপনি হয়তো জানেন, চলতি বছরে আমাদের ব্রয়লার মাংসের দাম খুব কম যাচ্ছে। ডিমের দাম একটানা কয়েক মাস খারাপ গেছে যদিও এখন কিছুটা ভালো। কিন্তু সেই টানা খারাপ পরিস্থিতিতে অনেক খামার ধ্বংস হয়ে গেছে, পথে বসে গেছে অনেক খামারি। বাস্তবতা হলো- খামারিরা না বাঁচলে, আমরাও বাঁচবো না। ব্যবসা করবো কিভাবে, আপনারাই বা লিখবেন কি নিয়ে? শুধুমাত্র সুষ্ঠু সমন্বয়ের অভাবে এসব হচ্ছে। খামারীরা বলছে, আমরা মরে যাচ্ছি। ডিলার বলছে আমি তো শেষ। প্যারেন্ট স্টক আর হ্যাচারি মালিকরা বলছে আমাদের তো সব চলে যাচ্ছে। বাস্তবতা হলো, আসলে আমরা সবাই ক্ষতির মুখে আছি। দড়ি টানাটানি করে লাভ নাই। যে যত বড় বিনিয়োগ করেছেন তার তত বেশি ক্ষতি হবে। একজনের লাভে কিংবা লসে আরেকজনের কোনো সম্পর্ক নাই। সবাইকেই বাঁচার ব্যবস্থা করতে হবে এবং ভোক্তাকে দরকারি জিনিসটাই তুলে দিতে হবে।
নেতিবাচক প্রচারণাও বাজার খারাপ হওয়ার একটি কারণ। দেখবেন কোনো কোনো মানুষ বলছে ব্রয়লার মুরগি ভালো না, এটা খেলে ক্যান্সার হবে, শরীরের ক্ষতি হবে। প্লাস্টিকের ডিম নিয়ে অপপ্রচার। সোস্যাল মিডিয়াতে দেখবেন এসব নানা অপপ্রচার চলছে। এখন সত্য হোক কিংবা মিথ্যা কিছু মানুষতো অবশ্যই সেগুলো কম-বেশি বিশ্বাস করছে। কারণ, তাদেরতো ওতো সময় নেই বিচার বিশ্লেষণ করার। কিছু অশুভ চক্র এসব করছে। এর ফলে ক্ষতির মুখে পড়ছি প্রান্তিক খামারি থেকে লিডিং পজিশনে থাকা কোম্পানীগুলো। কোনটা অপপ্রচার আর কোনটা দৈব ঘটনা সেটা যাচাই করে ব্যবস্থা নেয়ার দ্বায়িত্ব সরকারের।
এক্ষেত্রে আপনারা যারা মিডিয়া আছেন, তাদের কিন্তু একটা বড় ভূমিকা আছে কাস্টমারকে মুরগীর মাংস আর ডিম সম্পর্কে পজিটিভ দিকগুলো জানানোর। সারা বিশ্বের বড় বড় ফুড চেইনগুলো (ম্যাকডোনাল্ডস, কেএফসি, বার্গার কিংস সহ সবাই) এই মুরগী খাওয়াচ্ছে আমাদের। যদি নিরাপদই না হতো, উন্নত বিশ্ব কখনো করতো না। তাছাড়া একসময় মুরগী আর গরুর মাংশের দাম প্রায় একই ছিল। কিন্তু খামার হওয়ার কারণেই মুরগি ৯২-১০৫ টাকায় পাইকারী বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এই দামে মুরগি বিক্রি করে কেউ বাঁচার কথা না। আরও ৫০ ভাগ বেশি দাম পেলে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। মিনিমাম প্রফিট না হলে ব্যবসা সবাই একদিন ছেড়ে দিবেন। আপনারা শুনে থাকবেন যে, ব্রাজিল ও অন্যান্য দেশ উঠে পড়ে লেগেছে বাংলাদেশে মুরগি ও গরুর মাংস রপ্তানি করার জন্য। এরা অনুমতি পেলে পুরো শিল্প ধ্বসে পড়বে আর ভোক্তারা একদিন অনেক দামে এসব কিনে খেতে বাধ্য হবে। এখন পছন্দ আপনার।
আপনারা যদি বেশি বেশি করে নিরপেক্ষ সংবাদ প্রচার করেন যেমন, ব্রয়লার চিকেন অন্য অনেক উপাদানের চাইতে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো আর কম ঝুঁকিপূর্ণ, এটা অধিক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ, এতে ক্ষতিকর কিছুই নাই ইত্যাদি। তাহলে কিন্তু ডিমান্ডটা বেড়ে যাবে। মানুষ ভুল বুঝতে পারবেন।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: বিরাজমান পরিস্থিতিতে এবং বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে সেক্টরের সংগঠনগুলো কি করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক ড. দোহা: এদেশের মানুষ এক সময় সপ্তাহে একবার শখ করে নুডুলস খেতো বা ঘরে মেহমান এলে রান্না করে খাওয়ানো হতো। আর যারা একটু ভালো পজিশনে আছে তারা হয়তো বিকালে নাস্তা হিসেবে নুডুলস খেতো। কিন্তু নুডলস কোম্পানিগুলো কি চিন্তা করলো? মানুষ শুধু বিকেলে না, সকালের নাস্তা হিসেবেও নুডলস খাবে এবং মানুষকে সেটি খাওয়ানোর কৌশল বের করতে হবে। এক নুডলস দিয়েই তারা নানা ধরনের রেসিপি বিজ্ঞাপন শুরু করলো, ইনস্ট্যান্ট নুডুলস তৈরি করে বাজারে ছেড়ে দিলো যাতে মানুষ সহজেই খেতে পারেন। অর্থাৎ তারা সাপ্লাই দেয়ার আগে ডিমান্ড তৈরি করেছেন এবং মানুষ সেটা গ্রহণ করেছে। কাস্টমারকে এমনভাবে প্রমোট করছে যে, এখন দেখেন প্রত্যেকের ঘরে ঘরে নুডুলস থাকে। এখন আর কেউ এটাকে শুধু বিকালে খায় না। নুডুলস এখন নিত্যদিনের খাবার হয়ে গেছে। অফিসের ব্রেক টাইমেও ভাজা-পোড়ার বদলে অনেকে নুডলস খায়। কারণ তারা সেটার ভাল দিক তুলে ধরতে পেরেছেন। সেখানে আমাদের সুযোগ আরও বেশী।
এখন আমরা যদি একতাবদ্ধ হয়ে ব্রয়লার চিকেন ও ডিম সম্পর্কে পজিটিভ ধারনা তৈরি করতে পারি, সহজ পদ্ধতি শিখিয়ে দিতে পারি এবং সেগুলো প্রচার করতে পারি তাহলে আমরা সবাই লাভবান হবো। আমরা স্কুলের বাচ্চাদের টিফিনের জন্য চিকেনকে যদি সেইফ ঘোষণা করতে পারি তাহলে কিন্তু আমরা সবাই লাভবান হবো। আবার বিকালবেলা যে নুডুলস রান্না করা হচ্ছে সেখানে চিকেন দিয়ে রান্না করার জন্য মোটিভেট করতে পারি। সারা বিশ্বে কয়েক হাজার চিকেন রেসিপি পাওয়া যাবে। সেগুলো আমাদের আলোকে প্রমোট করতে হবে। কাস্টমারকে বুঝাতে হবে যে চিকেন খেলে কোলেস্ট্রর এর ঝুঁকি কমে, যাদের এলডিএল কোলেস্টোরেল আছে তাদের জন্য ব্রয়লার চিকেন উপযোগী। তাদেরকে বুঝাতে হবে চিকেন কিভাবে রান্না করলে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হবে। তাহলেই চিকেনের চাহিদা বেড়ে যাবে। আর তখন সাপ্লাইয়ের সাথে ডিমান্ডের সমন্বয় হবে।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: টেকসই পোলট্রি শিল্প করতে গেলে আমাদের কি করা উচিত? মোটা দাগে, পয়েন্ট আকারে উত্তর দিবেন প্লিজ?
অধ্যাপক ড. দোহা:: মোটা দাগে উত্তর দিতে গেলে আমাদের যা যা করতে হবে তা হলো-
- আমাদেরকে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।
- সাপ্লাই আর ডিমান্ডের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করতে হবে।
- ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে প্রবেশ করার চিন্তা করতে হবে। আমরা মধ্যপ্রাচ্যে চিকেন মিট রপ্তানি করতে পারি। আমাদের পাশের দেশ ভারত যদি পারে তাহলে আমরা কেনো পারবো না।
- সবাইকে মানসম্মত প্রোডাক্ট সম্পর্কে সঠিক জ্ঞ্যান নিতে হবে।
- প্রোডাক্ট এর কোয়ালিটি ঠিক রাখার জন্য সরকারকে একটা আইন করতে হবে এবং সেটা যথাযথ প্রয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
- আমাদের প্রোডাক্ট সাপ্লাইয়ের ক্ষেত্রে আরো নমনীয় হতে হবে যাতে ক্রেতা সঠিক সময়ে সঠিক এবং মানসম্মত প্রোডাক্ট পায়।
- আমাদের সবাই মিলে একটা ফান্ড তৈরি করতে হবে। সবাই যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী ফান্ডে টাকা রাখবে। বিভিন্ন এসোসিয়েশনকে আমাদের সাথে আনতে হবে। যাতে আমরা যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারি।
- ইতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে যেতে হবে।
- পোলট্রি কাঁচামালের মান নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। সাথে ডিউটিগুলো তুলে দিলে খামারিরা উপকৃত হবে। এই সেক্টরে ট্যাক্স তুলে দিলে ভাল হতো। এখনো সেই সময় আসেনি বলে আমি মনে করছি। কমপক্ষে একটা লেভেল পর্যন্ত করা উচিৎ।
- অযাচিতভাবে ভুল প্রচারণার শাস্তি দিতে হবে।
- আমাদের দেশেই পোলট্রি ডেইরী মেডিসিন বানাতে হবে। এই সেক্টরে বিশাল একটা অর্থ আমাদের দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: এবার আসি ডেইরি প্রসঙ্গে। বর্তমান কেমন চলছে শিল্পটি?
অধ্যাপক ড. দোহা: বর্তমানে ডেইরিতেও একই অবস্থা। মানুষ ২০টাকা দিয়ে একটা ২০০ এম.এল জুস কিনে খেতে পারে অথচ ২০ টাকা দিয়ে ২৫০ মিলি দুধ খেতে চায় না। অথচ জুসের চেয়ে কিন্তু দুধের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। এক্ষেত্রে ভো্ক্তাদের সচেতন করতে হবে। সোস্যাল মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছে আমাদের দেশে নাকি প্লাস্টিক এর ডিম পাওয়া যায়, চাল পাওয়া যায়, টিস্যু দিয়ে, শ্যাম্পু দিয়ে নাকি দুধ তৈরি করা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদেরকে বুঝতে মানুষ কিন্তু এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেইসবুকে সময় কাটায়। তাই উনারা ওখানে যা দেখে তাই বিশ্বাস করে। এক্ষেত্রে আমাদের ভোক্তাদের সচেতন করে তুলার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি বার বার একটা কথাই বলি আমাদের মধ্যে একতা থাকতে হবে। তথ্য নির্ভল ছোট ছোট ভিডিও করে আমরা ইউটিউবে এ প্রচার করতে পারি, সোস্যাল মিডিয়ায়ও প্রচার করতে পারি।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: আস্থার সংকট উত্তরণের জন্য কী করা উচিত এবং ভোক্তাদের ব্যাপারে আপনার মতামত ও বক্তব্য কি?
অধ্যাপক ড. দোহা: আমাদের দেশের ক্রেতা নিজের দেশের প্রোডাক্ট মান নিয়ে নিয়ে সংশয় করে। তারা আমদানি করা ড্রাগন ফল খাবে ৬০০-৮০০টাকা দরে কিন্তু আমাদের দেশের ড্রাগন ফল ২৫০-৩০০ টাকা দিয়ে খাবে না। অথচ আমাদের দেশের ড্রাগনফল আমদানি করা ড্রাগনফলের চেয়ে অনেক অনেক সুস্বাদু এবং পুস্টিগুন সমৃদ্ধ। এজন্য শুধু ভোক্তাদের দায়ি করলে চলবেনা। কারণ, আমাদের দেশে সাধারণত যে ফরমেটে খামার করা হয় উন্নত রাষ্ট্রে কিন্তু এভাবে হয় না। তাদের দেশের ভোক্তারা খামারিদের উপর আস্থা রাখতে পারে কারণ তারা জানে যে খামার থেকেই চিকেন নেয়া হোক না কেনো তাদের কোনো সমস্যা হলে তাদের দেশের সরকার, খামারি বা বিভিন্ন এসোসিয়েশন সম্পূর্ণ দ্বায়িত্ব গ্রহণ করবে। তাই সেসব দেশের ভোক্তাদের তাদের দেশের প্রোডাক্ট এর উপর পূর্ণ আস্থা আছে। আমাদেরও সেই আস্থার জায়গাটা প্রমাণ দিয়ে তৈরি করতে হবে। আমাদের এমন টেকনোলজি ব্যবহার করতে হবে যেনো ভোক্তা নিজেই পণ্যর মান যাচাই করতে পারে।
এক্ষেত্রে আমি ভোক্তাদের উদ্দেশ্যে একটি কথা বলতে চাই, আপনার একটু সময় পেলে আপনার আশে পাশে যে খামারগুলো আছে সেখানে যান। দেখেন তারা মুরগীকে কি খাওয়াচ্ছে, কোন কোম্পানীর ফিড খাওয়াচ্ছে, এতে কি কি উপাদান আছে। সেগুলো বাসায় এসে গুগুলে সার্চ করে দেখেন যে ফিডে উপাদানগুলো আছে সেগুলো আমাদের শরীরের জন্য ভালো কিনা। দয়া কর গুজুবে কান দিবেন না। এছাড়াও আমরা যে এতো সভা-সেমিনার করছি, সেসব বার্তা সব মানুষের কাছ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: শিল্পোদ্যোক্তা, খামারি এবং যারা নতুন খামার করতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন?
অধ্যাপক ড. দোহা: আমাদের দেশের পোল্ট্রি ও ডেইরি ইন্ডাষ্ট্রিতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে সেটা আমাদের জন্য আশির্বাদ। কিন্তু আমাদেরকে ব্যবসা করে যেতে হবে। এখানে দুটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। একটি ইনপুট মার্কেটিং আর একটি আউটিপুট মার্কেটিং।
আমরা ইনপুট মার্কেট করতে পারলেও যখন আউটপুট মার্কেটিং -এ যাই, মানে খামার থেকে ভোক্তাদের প্রোডাক্ট বিক্রি করতে আমাদের কিন্তু প্রচুর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। কারণ, আমরা এখনো ভোক্তাদের কাছে আমাদের উপর আস্থা অর্জন করতে পারি নাই। এইটার অনেক কারণ। কিছু অসাধু কারবারীর জন্য সবার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলাও ঠিক না। আমাদের সবাইকে খেতে হবে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিক করতে সকল পক্ষকে ধৈর্য্য ধরে এগুতে হবে। হুটহাট করে নেগেটিভ প্রচারণা সকলের মাঝে বিভাজন তৈরি করে। খামারিদের প্রতি আস্থা রাখুন। ভুল হলে আলোচনা করে শুধরে দিবেন।
আমাদের খামারিদের একটা সমস্যা হলো- যখন তারা একটি খামার শুরু করে তখন তারা প্রচুর পরিশ্রম করে। আর যখন দুই বা তিনটা ফ্লকে কিছু লাভের মুখ দেখে তখন আর খামারে সেইভাবে সময় দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। তখন তারা মনে করে, আমি তো ব্যবসা শিখে গেছি। খামারে লেগে থাকে, মুরগির ময়লা গায়ে মাখতে পিছপা হয়না এমন খামারি লোকসানে পড়ে কম। আসলে যত বছরই ব্যাবসা করেন না কেন, আপনাকে খামারে যেতে হবে।
অথচ এখনো গ্রামের অনেক খামারে দেখবেন সকাল ১১টা বেজে গেছে কিন্তু গেছে খামারের পর্দা তোলা হয় নাই, ফ্যান অন করা হয় নাই। মুরগিকে সময়মতো খাবার দেয়া হয় নাই। ঠিকমতো পানি দেয়া হয় নাই, পানির পাত্রগুলো শুকিয়ে গেছে ইত্যাদি। উনাদের আপনি খামারি বলবেন? তারা লস করবেনা তো কারা করবে? বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে খামার ব্যবস্থাপনা শিখতে হবে আর প্রয়োগ করতে হবে। প্রতিদিন এই সেক্টর পরিবর্তিত হচ্ছে। আপনাকেও সেই তালে শিখার চর্চা বাড়িয়ে দিতে হবে। ব্যবস্থাপনাই একটা খামারকে লাভজনক করতে যথেষ্ট।
আর কোনো কারণে খামারির লস হলে ডিলারকে সে বাকী টাকা শোধ দিতে পারছে না। ডিলার টাকা না পেলে ফিড, চিকস্ কোম্পানি টাকা পাচ্ছে না। এখানে কিন্তু একটা চেইনের মতো কাজ করে। খেয়াল করে দেখুন কার লস বেশী হচ্ছে।
নতুন উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো- কেউ যদি খামার করতে চায় তাহলে মিনিমাম যেনো ১০ থেকে ১৫ হাজার চিকেন নিয়ে এবং সম্পূর্ণ আধুনিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে যাতে শুরু করেন। অন্তত ছয় মাস লেখাপড়া করুন। জানুন, শিখুন, আলোচনা করুন। কারণ, ছোট খামারে আয়ের সাথে ব্যায়ের সমন্বয় রাখাটা কঠিন। বড় কোম্পানীগুলো যেভাবে খামার পরিচালনা করে ছোট খামারিদের পক্ষে কিন্তু সেভাবে চালানো সম্ভব না। একটা কোম্পানী যেভাবে প্রোডাক্ট এর কোয়ালিটি ঠিক রাখার জন্য টেকনোলজি ব্যবহার করে ছোট খামারীরে পক্ষে কিন্তু সেটা সম্ভব না। এসব কারণে তাদের উৎপাদন খরচও বেশি পড়ে। সেক্ষেত্রে ছোট কয়েকজন মিলে একটি বড় খামার করতে পারেন। অন্যথায়, বর্তমান বাজারে টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন। ডেইরি ও ক্যাটলের ক্ষেত্রেও একই পন্থা অবলম্বন করা উচিত। হুট করে না জেনে বুঝে বিনিয়োগ করলে হোচট খেতে হবে।
এগ্রিনিউজ২৪.কম: মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ড. দোহা: আপনাকেও ধন্যবাদ এবং এগ্রিনিউজ২৪.কম পরিবারের জন্য শুভ কামনা।