আনোয়ার ফারুক : ফুল একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল হিসেবে আজ বিশ^ব্যাপী বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে ফুলের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশেও ফুলের চাহিদা এবং চাষাবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে বিশ্ব বাজারে ফুলের বাজারে আমাদের বাণিজ্য অনেক পিছিয়ে। বিশ্ব বাজারে ফুলের বাণিজ্যের পরিমাণ যেখানে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশের সেখানে ১ হাজার কোটি টাকা। দেশে ফুলের চাহিদা ও ব্যবহারের ব্যাপকতা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে ফুলের উৎপাদন এখনো প্রান্তিক ও মাঝারি কৃষক নির্ভর। আমরা যদি একটু উদ্যোগী হই, ফুলের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে পারি তাহলে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে ফুলের বর্তমান বাজারের পরিমাণ কয়েকগুণ ছাড়িয়ে যাবে।
৮০’র দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিকরগাছায় প্রথম কয়েকজন প্রতিভাবান কৃষক ফুল চাষে উৎসাহ দেখান। পরবর্তীতে ১৯৮৩ সালে মাত্র ৩০ শতক জমিতে রজনীগন্ধা চাষের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ফুল চাষের প্রথম যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে শুধুমাত্র রজনীগন্ধা ও গাঁদা ফুলের চাষ দিয়ে এদেশের বাণিজ্যিক ফুল চাষ শুরু হলেও এখন গোলাপ, গ্লাডিওলাস, জার্বেরা, বেলী, লিলি, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদিসহ অনেক জাতের ফুল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ১.৫০ লাখ কৃষক দেশের ২৩টি জেলার ৮ হাজার হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ করছেন। তাছাড়া এ ব্যবসায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ১০ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করছে। ফুল আমাদের জাতীয় জীবনের একটি অন্যতম অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি সকল অনুষ্ঠানে ফুলের ব্যবহার অপরিহার্য।
বাংলাদেশে ফুল চাষের অপার সম্ভাবনা বিদ্যমান। আমাদের জমি, জলবায়ু ফুল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তাইতো মাত্র ৩০ বছরে ফুল চাষের এলাকা বৃদ্ধিসহ বাজারের আয়তন অনেক বেড়েছে। ফুল চাষ এখন আর যশোরের ঝিকরগাছায় সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে দেশের ২৩টি জেলায়। এদেশে বাণিজ্যিক ফুল চাষের সম্ভাবনা সত্তে¡ও উৎপাদন পর্যায়ে এখনো পড়েনি আধুনিকতা ও উন্নত প্রযুক্তির কোন ছোঁয়া। বাজার ব্যবস্থাপনা সনাতন এবং সংরক্ষণ ও পরিবহণের সুযোগ নেই বললেই চলে। ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলায় এখনও স্থাপিত হয়নি আধুনিক সুবিধাদিসহ ফুল বিক্রয় কেন্দ্র। এ খাতের আধুনিকায়নসহ বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। বাণিজ্যিক ফুল চাষে প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন যা প্রান্তিক চাষিদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই, বেসরকারি খাত ফুল চাষে বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় অনগ্রসর এ খাতকে আরো উন্নয়ন করে দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির সুযোগ নিতে পারে।
বাংলাদেশে ফুল চাষে অপার সম্ভাবনা থাকলে এ খাতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে তেমন কোন আগ্রহ নেই বললেই চলে। এর পিছনে মূলতঃ যেসব কারণ দায়ী-
˙ ফুল চাষের এবং ফুলের বাজার সম্পর্কে তথ্য ও উপাত্তের অভাব;
˙ দেশে ফুল চাষের কোন নীতিমালা নেই;
˙ বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে এ খাতকে এখনও থ্রাস্ট সেক্টর (Thrust Sector) হিসেবে হিসেবে ঘোষণা না দেয়া;
˙ গবেষণা ব্যবস্থায় দুর্বলতা;
˙ আধুনিক প্রযুক্তির অভাব;
˙ ফুল চাষে অভিজ্ঞ ও দক্ষ লোকবলের অভাব;
˙ চারা, কলম, বীজ ইত্যাদি আমদানির সীমাবদ্ধতা;
˙ উন্নত জাতের অভাব;
˙ গ্রীন হাউজসহ অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা এবং আমদানিতে সীমাবদ্ধতা;
˙ ঋণ প্রদানে সুনির্দিষ্ট নীতিমালার অভাব;
˙ অবকাঠামো (Infrastructure) খাতে সরকারের বিনিয়েগের অভাব;
˙ এ খাতের প্রতিনিধিত্বকারী নেতৃত্বের অভাব এবং
˙ সর্বোপরি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব।
এ কথা সত্য যে, সরকার ইতোমধ্যে ফুল চাষকে অত্যন্ত লাভজনক অর্থকরী ফসল হিসেবে চিহ্নিত করে এর উন্নয়নে কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে ঢাকায় একটি কেন্দ্রীয় বিপণন কেন্দ্র স্থাপনসহ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণা ও টিস্যু কালচার ল্যাব স্থাপন অন্যতম। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কিছু কিছু দাতা সংস্থাও ইতোমধ্যে ফুল চাষিদের উন্নয়নে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে, প্রয়োজনের তুলনায় যা অতি সামান্য। এ খাতের উন্নয়নে মূল ভূমিকা সরকারকেই পালন করতে হবে।
আধুনিক ফুল চাষে প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন এবং বেসরকারি খাত এগিয়ে না আসলে কোন অবস্থাতেই এ খাততে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর করা সম্ভব হবে না। তাই দ্রুত ফুল চাষ সম্পর্কিত একটি নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে উল্লেখিত প্রতিবন্ধকতাসমূহ দূর করার মধ্য দিয়ে এ খাতে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা সম্ভব। একটি সুস্পষ্ট, কার্যকর এবং বাস্তবমুখী নীতিমালা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এ খাতকে একটি সুশৃঙ্খল খাতে উন্নতি করে দেশের ফুল চাষী, ব্যবসায়ী এবং জাতীয় আয় বৃদ্ধিসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ফুল চাষ বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।