আবিদুর রহমান আবিদ: সাতক্ষীরার গাবুরা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন এবং শ্যামনগর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় থানা। আগে থেকেই আমরা ট্রলার ঠিক করে রেখেছিলাম। সেখানে যে কয়দিন থাকবেন সেই কয় দিনের বাজার করে ট্রলারে উঠতে হবে। আমার বাসা ওখানে হওয়ায় আমার আব্বু আগে থেকেই বাজার করে রেখেছিল। ট্রলারেই রান্না করতে হবে, খেতে হবে এবং টয়লেটের ব্যবস্থাও ট্রলারে। সুন্দরবনে গোসল করাটা ঝামেলার। সব জায়গায় লোনা পানি। তবে আপনি দুবলার চর মসজিদের পাশে, বাগেরহাট শরনখোলা রেন্জের কোকিলমনি কোস্টগার্ড ক্যাম্প এবং হিরন পয়েন্টে মিঠা পানির পুকুর পাবেন। চাইলে সেখানে গোসল করতে পারেন। আগে থেকে বনবিভাগের অনুমতি নিয়েছিলাম খুলনা থেকে সাথে ২ জন কোস্ট গার্ড সাথে ছিল। অনুমতিসহ যাবতীয় সবকিছু আগে থেকে যারা যাবেন তাদের সবার ন্যাশনাল আইডি কার্ড এবং টাকা পাঠাতে হয়েছিল।
আমার মনে হয়েছে সুন্দরবনের আসল রুপ জাহাজে গিয়ে দেখা সম্ভব না। ট্রলারে ঘুরলে অনেক গভীরে যাওয়া যায় এবং অনেক কিছুই দেখা সম্ভব। আপনি নীলডুমুর ঘাট থেকে প্রথমে কলাগাছিয়া বিচ যেতে পারেন। কলাগাছিয়াতে প্রচুর হরিণ আর বানর দেখতে পারবেন। কলাগাছিয়া বিচের হরিণ খাবারের জন্য লোকালয়ে উঠে আসে। ওদের খাবার দিলে আপনার একেবারে কাছাকাছি চলে আসবে। কলাগাছিয়া বিচ দেখে কলাগাছি নদী এবং ঘোলপেটুয়া নদীর অসাধারণ ভিউ দেখতে দেখতে রাতে ভ্রমরখালী টহল ক্যাম্প ঘাটে ট্রলার নোঙ্গর করতে পারেন। বন কর্মকর্তারা নতুন মানুষ পেলে প্রচুর গল্প করবে। কারণ মাসের পর মাস গভীর জঙ্গলে একাকী দিন কাটে তাদের। ভ্রমরখালী টহল ক্যাম্পের পেছনে গিয়ে টর্চ মারলে প্রচুর হরিণ দেখতে পারবেন। আর টহল ক্যাম্পের পেছনের রাস্তা দিয়ে কিছু দূর সামনে গেলে একটা মিঠা পানির পুকুর আছে। ঐ খানেও প্রচুর হরিণ থাকে রাতে। কিন্তু বন কর্মকর্তা এবং তাদের সাথের বন্দুক ছাড়া ঘাটের পাড়ে যাবেন না। অবশ্য এমনিতেই বন কর্মকর্তারা আপনাকে একা যেতে দিবে না। রাতে ভ্রমরখালী টহল ক্যাম্পের ঘাট মোটামুটি নিরাপদ। ঘাট থেকে একটু দূরে ট্রলার নোঙ্গর করলেই আর কোনো সমস্যা নেই।
ভ্রমরখালী টহল ক্যাম্পের ঠিক বিপরীত পাশেই ভাগ্য ভালো বা ভাগ্য খারাপ হলে রাতে রয়েল বেঙ্গল এর গর্জন শুনতে পারবেন। পরের দিন সকালে ভ্রমরখালী থেকে একটু সামনে গেলেই পড়বে বাগেরহাটের কোকিলমনি কোস্ট গার্ড ক্যাম্প। ওইখানে নাম এন্ট্রি করার জন্য নামতে হবে। এই ফাঁকে আপনি কোকিলমনি কোস্ট গার্ড ক্যাম্পের পেছনের লাল শাপলার পুকুর এবং জঙ্গল না দেখলে অনেক কিছু মিস করে ফেলবেন। লাল শাপলার পুকুরে হরিণ পানি খেতে আসে। লাল শাপলা ভরা পুকুরে হরিণের পানি খাওয়া দেখতে মন্দ লাগবে না। তবে অবশ্যই বন কর্মকর্তাদের সাথে নিয়ে যাবেন। ওইখান থেকে সুন্দরবনের বিভিন্ন নালা, খাল, বন এবং বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে ৬ ঘন্টা লাগবে বাগেরহাটের শরনখোলা রেন্জের কটকা পৌঁছাতে। কটকাতেও প্রচুর হরিণ এবং ভাগ্য ভালো থাকলে টাইগার টিলায় বাঘও দেখতে পারবেন। কটকা থেকে কঁচিখালী যাবেন। কটকা থেকে জামতলী বিচ যেতে ১০ মিনিট লাগবে। জামতলী বিচ যাওয়ার সময় বাঘবনের মধ্যে দিয়ে মূল বিচে যাওয়ার সময়টুকু আপনার সারা জীবন মনে থাকবে।
গাঁ ছমছম করা পরিবেশ। চারদিক খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করে সামনের দিকে এগোতে হবে। অবশ্যই সবার সামনে একজন বন্দুকধারী বন পুলিশ এবং সবার পেছনে আরেকজন বন্দুকধারী বন পুলিশকে রেখে সামনের দিকে এগোতে হবে। জামতলী থেকে ৪ ঘন্টার মতো লাগবে দুবলার চর পৌঁছাতে। দুবলার চরের জেলে পাড়া এবং শুঁটকি পল্লি দেখতে ভুলবেন না। দুবলার চরের সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত খুবই সুন্দর। আর জেলেদের মাছ নিয়ে শুঁটকি পল্লি যাওয়ার দৃশ্যও খুবই সুন্দর। রাতে দুবলার চর থেকে পরের দিন সকালে চলে যান খুলনা রেন্জের হিরন পয়েন্ট। হিরন পয়েন্টে একটা মিঠা পানির পুকুর আছে। মিঠা পানির পুকুরে গোসল সেরে নিতে পারেন। এরপর হাড়বাড়িয়া, করমজল এবং মান্দারবাড়ীয়া সি বিচ দেখে সাতক্ষীরা অথবা খুলনা দিয়ে ফিরে আসতে পারেন। ট্রলারে ঘুরলে অনেক গভীরে যেতে পারবেন। বিশেষ করে রাতে যখন গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রলার চলবে তখন সারা শরীরে অদ্ভুত এক শিহরন জাগবে। সুন্দরবনের বনের মধ্যে দিয়ে রাতের ট্রলার ভ্রমন সারা জীবন মনে রাখার মতো।
পুরা ট্যুরে প্রচুর খাওয়া দাওয়া হয় প্রতি বেলায় মুরগী, মাছ, ডিম, ডাল, ভর্তা আর সালাদতো ছিলোই। আশিক ভাই আগেই ফেরার টিকিট বুকিং দিয়ে যায় সেভেন স্টার পরিবহনে। আমরা নীলডুমুর এ পৌছায় সন্ধায় সেখানে থেকে অটোতে করে মুন্সিগঞ্জ এ এসে বাস না পাওয়ায় আবার অটোতে করে শ্যামনগর পৌছায় আমাদের বাস রাত ৮ টায় ছাড়ে। সাতক্ষীরা পৌঁছে সাতক্ষীরার বিখ্যাত সন্দেশ কেনা হয় ট্যুরের সব মেম্বারকে খাওয়ানোর জন্য। রাত ১১ টায় আমরা খুলনা জিরো পয়েন্ট পৌঁছে সাতক্ষীরার বিখ্যাত চুই ঝালের মাংস খাই। ট্যুর থেকে ফেরার পর ১৩ জন মেম্বারের ডিসেনট্রি হয় চুই ঝাল খাওয়ার কারণে। বেকুটিয়া ফেরিতে রাত ২ টায় পার হই। লেবুখালী ফেরিতে পৌছায় রাত ৩ টায়, প্রচুর জ্যাম ছিলো ফেরি ঘাটে। ভোর ৫ টায় আমরা ক্যাম্পাসে পৌছায়। ট্যুরটি আয়োজন করতে আশিক ভাই, আমি, প্রতয়, শায়েখ, সাকিব কষ্ট করেছি। বিশেষ করে কম টাকায় এতোগুলো স্পট, থাকা খাওয়া। আমার আব্বু, বাবুচি, বোটওয়ালাও তাদের সর্বোচ্চটা দিয়েছিলো।
আসুন ভ্রমনে গিয়ে যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলা থেকে বিরত থাকি। ট্রলার বা জাহাজ থেকে পানির বোতল, চিপসের প্যাকেট নদী বা সমুদ্রে ফেলবেন না। পরিবেশ ময়লা-আবর্জনা মুক্ত রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
লেখক: শিক্ষার্থী, কৃষি অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।