পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারি ও রংপুরে বিপিআইসিসি–ডিএলএস’র খামারি প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত রোগ-জীবাণু মুক্ত খামার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে লাভজনক খামার গড়া এবং নিরাপদ ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদনে তৃণমূল খামারিদের দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিস) যৌথ উদ্যোগে পঞ্চগড়, নীলফামারি ও ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা এবং রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় গত ২৩ জুন থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় জীবনিরাপত্তা বিষয়ক কর্মশালা।
কর্মশালা আয়োজনের পূর্বে উল্লিখিত চার উপজেলায় একটি জরিপ পরিচালনা করা হয় এবং এর মাধ্যমে সচল ও নিবন্ধিত খামার ও পোল্ট্রি বার্ডের সংখ্যা, ডিম ও মুরগির মাংসের উৎপাদন প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। গত ২৩ জুন পঞ্চগড়ে অনুষ্ঠিত হয় নিরাপদ পোল্ট্রি পালন বিষয়ক কর্মশালা। এতে রিসোর্স পারসন হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা দেবাশীষ দাস ও ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মো. মোজাম্মেল হক। ঔষধের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে জীব নিরাপত্তার ওপর গুরুত্ব বাড়ানোর পরামর্শ দেন দেবাশীষ দাস।
তিনি বলেন, খামারে এমন পরিবেশ বজায় রাখতে হবে যেন রোগ-জীবাণুর সংক্রমণ না হতে পারে। গ্রাম এলাকায় অনেক সময় আত্মীয়রা বেড়াতে এলে মুরগির খামারে প্রবেশ করতে চান। এ ব্যাপারে সচেতন থাকার পরামর্শ দেন তিনি। উপস্থিত একজন খামারি বলেন, একদিন তাঁর বেয়াই বেড়াতে এসে খামার দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন কিন্তু তাঁকে খামারে ঢুকতে না দেয়ায় মনক্ষুন্ন হন বেয়াই। কাকতালীয়ভাবে পঞ্চগড়ের কর্মশালায় উক্ত খামারির বেয়াইও উপস্থিত ছিলেন।
খামারি বলেন, সেদিন কেন তিনি তাঁর বেয়াই কে খামারে প্রবেশে নিরুনুৎসাহিত করেছিলেন এতদিন পর আজ হয়তো তার বেয়াই তা বুঝতে পেরেছেন। ডিএলও দেবাশীষ দাস বলেন, যে কোন বাহকের মাধ্যমেই জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে এমনকি খামার পরিদর্শনকারি ভেটেরিনারি ডাক্তার যদি নিয়ম না মেনে খামারে প্রবেশ করেন তাহলেও জীবাণু সংক্রমিত হতে পারে। পঞ্চগড়ের জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ জেলায় নিবন্ধিত মুরগির খামারের সংখ্যা ২৩৫ টি, জিপি ও পিএস খামার ১৭টি এবং ফিড মিলের সংখ্যা ২টি। বছরে ডিম উৎপাদিত হয় ১৬ কোটি ১৭ লাখ, মুরগির মাংস উৎপাদিত হয় ৪৪ হাজার ৪৩৭ মেট্রিক টন। এদিকে পঞ্চগড় প্রাণিসম্পদ অফিস ও বিপিআইসিসি’র যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত জরিপ থেকে জানা যায় পঞ্চগড় সদর উপজেলায় মোট ১২৮টি ব্রয়লার খামার ও মাত্র ১টি লেয়ার খামার রয়েছে। ব্রয়লার বার্ডের সংখ্যা ১,১৫,০২০ টি ও লেয়ার বার্ডের সংখ্যা ১৮০০টি। সদর উপজেলায় মোট খামারের সংখ্যা ১২৯টি হলেও নিবন্ধিত খামারের সংখ্যা মাত্র ৫টি। ঠাকুরগাঁও সদরে কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় ২৪ জুন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজি ওয়াসিউদ্দিন, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগের উপ-পরিচালক হাবিবুর রহমান, সভাপতিত্ব করেন ঠাকুরগাঁও এর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কৃষিবিদ জনাব আলতাফ হোসেন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন এলডিডিপি প্রকল্পের ডিপিডি ডা. জহিরুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ মো. আব্দুর রহিম, বিপিআইসিসি’র সচিব দেবাশিস নাগ, যোগাযোগ ও মিডিয়া উপদেষ্টা মো. সাজ্জাদ হোসেন এবং অফিস এক্সিকিউটিভ আবু বকর। ওয়াসিউদ্দিন বলেন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, জীবনিরাপত্তার কোন বিকল্প নাই। ভেজাল ও অনিরাপদ খাদ্য মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। তিনি বলেন, বিজ্ঞানভিত্তিক খামারই খামারিকে লাভবান করতে পারে। বিশুদ্ধ পানি, ব্রান্ড কোম্পানীর ফিড ও বাচ্চা এবং নিয়মিত টিকা দেয়ার পরামর্শ দেন ওয়াসিউদ্দিন। অনুপ্রাণিত করার জন্য খামারিদের একটি সফল খামারের গল্প শোনান তিনি। হাবিবুর রহমান এন্টিবায়োটিক কে ‘না’ বলার আহ্বান জানান। ভেট ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন তিনি।
আলতাফ হোসেন বলেন, আয়োজিত কর্মশালার মাধ্যমে খামারি ও স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অফিসের মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, খামারিদের ত্যাগের কারণেই ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ আজ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। তিনি বলেন, মূলধনের সীমাবদ্ধতার কারণে পোল্ট্রি খামারিরা ডিলারদের কাছে এবং পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে ঔষধ সরবরাহকারি প্রতিষ্ঠানের রিপ্রেজেন্টেটিভদের প্রতি অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। জেলা প্রাণিসম্পদ সূত্রে জানা যায়, ঠাকুরগাঁও জেলায় মোট নিবন্ধিত মুরগির খামারের সংখ্যা ৩৫৫টি। এর মধ্যে লেয়ার খামার ১৩৭টি ও ব্রয়লার খামার ২১১টি। প্যারেন্টস্টক খামার ৫টি, জিপি ফার্ম ১টি এবং ফিড মিলের সংখ্যা ৩টি। নীলফামারিতে নিরাপদ পোল্ট্রি পালন বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় ২৫ জুন। রিসোর্স পারসন হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. মোনাক্কা আলী এবং সদর উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. শেখ এম.এ. মতিন। তাঁরা বলেন, পোল্ট্রি সম্পর্কে সবকিছু জেনে ফেলেছি এমন ভাবার সুযোগ নাই। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বড় খামারিও বড় ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন সামান্য উদাসীনতার কারণে। তাই উন্নত খামার ব্যবস্থাপনা ও রোগজীবাণু সম্পর্কে আপডেট থাকার পরামর্শ দেন তাঁরা। একই সাথে নিজেদের স্বার্থরক্ষায় একতাবদ্ধ হয়ে থাকারও পরামর্শ দেন। সদর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের সহযোগিতায় নবগঠিত ‘নীলফামারি পোল্ট্রি খামারি ও ব্যবসায়ী সমিতি’র সভাপতি ও সাধার নসম্পাদকদের সাথে খামারিদের পরিচয় করিয়ে দেন জনাব মতিন।
জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় সূত্রে জানা যায় নীলফামারি জেলায় লেয়ার মুরগির খামার ১৮টি, ব্রয়লার মুরগির খামার ৯৩টি, প্যারেন্টস্টক খামার ৩টি, হাঁসের ১২টি, কোয়েল ১৫টি, কবুতর ২৪টি, ফিড মিল ২টি এবং আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামার ১টি। টার্কি মুরগির সংখ্যা ৪৯৮২ টি ও বাণিজ্যিক মুরগির সংখ্যা ৪৮১,৯৯৭টি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ডিম উৎপাদিত হয়েছে ৩১৩.৯৪ লক্ষ পিস এবং মাংস ১৬৩.৪৬ লক্ষ কেজি। রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় ২৬ জুন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রংপুরের জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. শাহজালাল খন্দকার, উপজেলা চেয়ারম্যান আবু নাসের শাহ মো. মাহবুবার রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন প্রধান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মোছা. তানজিনা আফরোজ, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকতা ডা. মো. শামসুজ্জামান এবং পোল্ট্রি খামারি মালিক সমিতির সম্পাদক মুজাহেদুল ইসলাম মিলন। জেসমিন প্রধান বলেন, সবার জন্য নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা দিতে চায় সরকার। তাই নিরাপদ ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদনে খামারিদের আরও বেশি সচেতন হতে হবে। খামারের চারপাশ বেস্টনী দিয়ে ঘিরে রাখা; বন্য পাখি, ইঁদুর, কুকুর, বেড়াল প্রতিরোধ করা, খামারের জন্য পৃথক পোষাক ব্যবহার, জীবাণুনাশকের ব্যবহার প্রভৃতি বিষয়ে পরামর্শ দেন প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা শাহজালাল খন্দকার।