ইফরান আল রাফি: কৃষি প্রধান বাংলাদেশের দক্ষিণ বাংলার উচ্চতর কৃষি শিক্ষার একমাত্র বাতায়ন উন্মুক্ত হয়েছিল ১৯৭৯ সালে পটুয়াখালী কৃষি কলেজ সৃষ্টির মাধ্যমে। ২০০০ সালের ৮ জুলাই পটুয়াখালী কৃষি কলেজ অবকাঠামোতেই পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিওিপ্রস্তর উদ্ধোধন করেন তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনা ১৯৯৪ সালের ২২ অক্টোবর বিরোধীদলীয় নেত্রী হিসেবে পটুয়াখালী জেলার লেবুখালীতে এক পথসভায় অত্র কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রতিশ্রুতি দেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালের ১৫ মার্চ পটুয়াখালীতে এক জনসভায় পটুয়াখালী কৃষি কলেজকে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরুর জন্য প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০০০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর কৃষি অনুষদে প্রথম ব্যাচে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির মাধ্যম ক্লাস কার্যক্রম শুরু হয়।
বর্তমানে ৮টি অনুষদের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। কৃষি অনুষদ, কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইন্জিনিয়ারিং অনুষদ, ব্যবসায় প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা অনুষদ, মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদ, এ্যানিমেল সায়েন্স এন্ড ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদ, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান অনুষদ, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন অনুষদ। পটুয়াখালী জেলা শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার উত্তরে এবং বরিশাল বিভাগীয় শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দক্ষিণে বরিশাল পটুয়াখালী মহাসড়কের লেবুখালী থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলার প্রাণকেন্দ্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস অবস্থিত। যার আয়তন ৭৭.০০ একর। বহিঃস্থ ক্যাম্পাস বরিশাল জেলার খানপুরা, বাবুগঞ্জে অবস্থিত। যার আয়তন ১২.৯৭ একর।
বর্তমানে কৃষি অনুষদ ১৪টি বিভাগের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে। দক্ষ শিক্ষকমণ্ডলী, বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সজ্জিত ল্যাবরেটরি, শিক্ষা উপকরণ সম্বলিত শ্রেণী কক্ষ ও সুবৃহৎ কৃষি খামারের সহায়তায় প্রায়োগিক জ্ঞান বিতরনের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান সমৃদ্ধ কৃষিবিদ তৈরী করছে। ইতোমধ্যে কৃষিতত্ত্ব, উদ্যানতত্ত্ব, কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব, কীটতত্ত্ব এবং মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের মাধ্যমে ছাত্র ছাত্রীদের পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। উল্লেখ্য, দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও কৃষি উন্নয়নে পবিপ্রবির আগ্রণী ভূমিকা সকলের কাছে স্বীকৃত। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ২০০৩-০৪ সেশনে CSE অনুষদ ৪১ জন ছাত্র ছাত্রী ভর্তির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। অত্র অনুষদে ৫ টি বিভাগ এবং ৬ টি প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ল্যাবরটরির মাধ্যমে শিক্ষাদান করে আসছে। মোবাইল গেমস ও এ্যাপ্লিকেশন দক্ষতা উন্নয়নে অত্যাধুনিক মানের ল্যাব নির্মাণ এবং তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রনালয়ের সহযোগিতায় অত্যাধুনিক মানের Advanced Computing Laboratory নির্মাণ করা হয়েছে।
ইতোমধ্যে এ অনুষদ থেকে ১১ টি ব্যাচে ৪২৯ জন শিক্ষার্থী ডিগ্রি গ্রহণ করে কর্মক্ষেত্রে সুনামের সাথে কর্মরত আছন। ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে দক্ষ কারিগর ও সুযোগ্য নেতৃত্ব তৈরীর লক্ষ্যে ২০০৩-০৪ সেশনে ছাত্রছাত্রী ভর্তির মাধ্যমে ব্যবসায় প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা অনুষদের যাত্রা শুরু হয়। HEQEP AIF এর সহায়তায় একটি অত্যাধুনিক Digital IT cum Language Lab রয়েছে। বর্তমানে এ অনুষদ Copenhagen University, Denmark; BAU and Faculty of Fisheries, PSTU এর সাথে Upgrading Pangas and Tilapia Value Chains in Bangladesh নামক একটি যৌথ প্রকল্পের সাথে যুক্ত রয়েছে। ইতোমধ্যে এ অনুষদ থেকে ৫০৩ জন শিক্ষার্থী বিবিএ এবং ১৬০ শিক্ষার্থী এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছে এবং ইএমবিএ প্রোগ্রামের আওতায় ১৬২ জন শিক্ষার্থী এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছে। জাতীয় পুষ্টি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে সুদক্ষ, প্রশিক্ষিত গ্রাজুয়েট তৈরী এবং এ সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা পরিচালনার অঙ্গিকার নিয়ে মাৎস্য বিজ্ঞান বিভাগ ২০০৭-০৮ সেশনে ১৮ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তির মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে।
পরবর্তীতে ২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর এটি মাৎস্য বিজ্ঞান অনুষদ হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে। ইতোমধ্যে এ নবীন অনুষদ থেকে ২৫২ জন শিক্ষার্থী স্নাতক, ৭২ জন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এ অনুষদের শিক্ষকদের তত্ত্ববধায়নে DANIDA কর্তৃক অর্থায়নে ইউরোপ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে BANGFISH নামক প্রকল্পসহ আরো ১০ টি গবেষণা প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। স্থিতিশীল সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ আহরণ ও ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কুয়াকাটায় একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী Marine Fisheries Research Institute প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এ্যানিমেল সায়েন্স ও ভেটেরিনারি মেডিসিন অনুষদ ৫ বছর মেয়াদী ডক্টর অব ভেটেরিনারি মেডিসিন ডিগ্রি এবং ৪ বছর ৬ মাস মেয়াদী বি এস সি ইন এ্যানিমেল হাজবেন্ড্রী ডিগ্রি প্রদান করে আসছে। ইতোমধ্যে এ অনুষদ থেকে ৫১০ জন শিক্ষার্থী ডিভিএম ডিগ্রি এবং ১০০ জন শিক্ষার্থী বি এস সি ইন এ্যানিমেল হাজবেন্ড্রী ডিগ্রি লাভ করেন। এ অনুষদ থেকে ৭৪ জন শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ভেটেরিনারি টিচিং হাসপাতাল, অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার ও ভ্রাম্যমান (এ্যাম্বুলেন্স) প্রাণী স্বাস্থ্যসেবা চালু আছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট বিপর্যয় মোকাবেলার শিক্ষায় সুশিক্ষিত দক্ষ মানব হিতৈষী পেশাজীবী গড়ে তোলার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনুষদ,পবিপ্রবি এশিয়ার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে বহুমুখী পাঠ্য বিষয় সম্বলিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি চালু লক্ষ্যে ২০০৯-১০ সেশনে ছাত্রছাত্রী ভর্তি শুরু করে। ইতোমধ্যে ৫টি ব্যাচে ১৮০ জন স্নাতক ও ৭৫ জন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
অত্র অনুষদের গ্রাজুয়েটরা সুনামের সাথে কর্মজীবন পরিচালনা করে আসছেন। খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে সর্বোচ্চ জ্ঞান প্রদানের লক্ষ্যে ২০১২ সালে ৭ টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে নিউট্রিশন এন্ড ফুড সায়েন্স অনুষদ। ইতোমধ্যে ৩টি ব্যাচে মোট ১১৩ জন শিক্ষার্থী স্নাতক এবং ৭০ জন শিক্ষার্থী এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৬ সাল থেকে UNICEF Bangladesh এর সার্বিক সহযোগীতায় Nutrition Internship Programme for the Student of Faculty of NFS প্রকল্প চালু রয়েছে। দেশের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৫-১৬ সেশনে ৫ টি বিভাগ নিয়ে ভূমি ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসন অনুষদ চালু হয়েছে। আশা করা হয়, অত্র অনুষদের শিক্ষার্থীরা দেশের ভূমি উন্নয়ন, দক্ষ ভূমি ব্যবহার ও ভূমি বিরোধরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বর্তমানে ছাত্রছাত্রীদের জন্য মোট আবাসিক হল ৯ টি। মূল ক্যাম্পাসে আবাসিক হল আছে মোট ৬টি। শের-ই-বাংলা হল-১, শের-ই-বাংলা হল -২, এম. কেরামত আলী হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, কবি বেগম সুফিয়া কামাল হল ও শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। বহিঃ ক্যাম্পাসে আছে ৩টি হল। বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর হল, শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল এবং নির্মাণাধীন ১ টি হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার হিসেবে বিবেচিত।
বর্তমানে গ্রন্থাগারে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট মজুদ সংখ্যা ২৫৬৯৫টি বই, ২৮১০টি জার্নাল, ২২৮০টি সাময়িকী, ৭১২টি এম. এস. থিসিস, ৬৬টি পিএইচডি থিসিস, ৪৫২টি বিবিএ ইন্টার্নশিপ রির্পোট ও থিসিস, ১১০টি সিএসই ইন্টার্টশিপ রির্পোট, ১০৯টি ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইন্টার্নশিপ রির্পোট ও থিসিস। রয়েছে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত ৪ তলা বিশিষ্ট টিএসসি ভবন। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কেন্দ্রীয় মসজিদ এবং একটি কেন্দ্রীয় মন্দির রয়েছে। ৪৫০ আসন বিশিষ্ট একটি অডিটোরিয়া। শরীর চর্চা অংশ হিসেবে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি সম্বলিত একটি জিমনেসিয়াম রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে চন্দ্রদ্বীপ সুধিনীড়, নির্ঝর ও ছায়াবীথি নামে ডরমিটরি রয়েছে। এছাড়াও মূল ক্যাম্পাসে ২টি, বহিঃস্থ ক্যাম্পাসে ১টি এবং ঢাকায় ১টি। চিকিৎসা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে ৪ তলা ভবন বিশিষ্ট হেলথ কেয়ার সেন্টার রয়েছে।
ক্যাম্পাস প্রাঙ্গনে রয়েছে শহীদ মিনার, জয় বাংলা স্মৃতি ভাস্কর্য, সাত বীরশ্রেষ্ঠের ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধুর আবক্ষ ও ম্যুরাল। শিক্ষার্থীদের আড্ডা ও ভালো লাগার স্থানগুলো মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্যারিস রোড, বকুল তলা, তালতলা, লাল কোমল ও নীল কোমল লেকের পাড়। দারিদ্র মুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শিক্ষা, গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণের নিমিত্তে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আজ পথ চলার ১৯ তম বছরে।
লেখক: শিক্ষার্থী, কৃষি অনুষদ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।