মাকসুদুল হাসান: দুগ্ধ উৎপাদনের মাধ্যমে একটি শ্বেত বিপ্লব ঘটানোর স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংক যে ৫০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিচ্ছে তার প্রায় ১৪ কোটি ডলারই ব্যয় হবে দেশের ডেইরি শিল্পের উন্নয়নে। যার মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে মাথাপিছু দুধের সরবরাহ এবং নিরাপদ দুধ। গত বছরের ডিসেম্বরেই সরকারের সাথে এই ঋণ চুক্তি করেছে বিশ্বব্যাংক।
শিক্ষিত তরুণরাও এখন ঝুঁকছেন ডেইরি শিল্পের দিকে। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মার্স এসোসিয়েশনের পরিসংখ্যান বলছে, তাদের ৮১ হাজার সদস্যের মধ্যে ৫০ হাজার সদস্যই স্নাতক পাশ। অর্থাৎ শিক্ষিত তরুণদের হাতেই এখন শ্বেত বিপ্লবের হাতিয়ার। তাদের বিনিয়োগ এবং বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর এ খাতে বিনিয়োগে গত পাঁচ বছরে দেশে দুধের উৎপাদন তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে। ৩০ হাজার লাখ থেকে বেড়ে তা এখন ৯৪ হাজার লাখ টন।
তবুও ঘাটতি রয়ে গেছে ৫৬ হাজার লাখ টন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাব বলছে, মাথাপিছু দৈনিক ২৫০ মিলি লিটার দুধের প্রাপ্যতা থাকার কথা থাকলেও সরবরাহ ১৯৮ মিলি লিটার। যদিও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা বলছে মাথাপিছু দুধ গ্রহণের পরিমাণ মাত্র ১২৫ মিলি লিটার। অর্থাৎ প্রয়োজনের অর্ধেক দুধ খাচ্ছে এ দেশের মানুষ। যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও সবচে নীচে।
দুধের উৎপাদন বাড়ানো ও মানুষের খাদ্যাভাসে দুধ গ্রহণের পরিমাণ বাড়ানোর পাশাপাশি গ্রামীণ অর্থনীতিকেও গতিশীল করার চ্যালেঞ্জ নিয়ে যখন শ্বেত বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটা শুরু করেছে বাংলাদেশ, ঠিক তখনই দুধ কেলেংকারি জন্ম দিয়েছে নতুন বিতর্ক।
বিষাক্ত দুধের খবরে নড়ে-চড়ে বসেছে গোটা জাতি। দুধ নিয়ে এখন চলছে তুলকালাম কাণ্ড। দুধ বিশেষজ্ঞদেরও চিনতে পারছে আমজনতা। গত বছরের মে মাসে পাস্তুরিত দুধের ৭৫ শতাংশই ভেজাল বলে জানায় আইসিসিডিডিআর,বি এর গবেষণা। তার বছর খানেক পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার ও ফার্মেসি অনুষদের যৌথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা জানায় পাস্তুরিত ও অপাস্তুরিত দুই ধরণের দুধই মানবস্বাস্থ্যের জন্য এক ভয়াবহ হুমকি। লিভোফ্লক্সসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, অক্সিটেট্রাস্লাইকিন ও এজিথ্রোমাইসিনের মত এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে যার মাত্রা ক্ষতিকর পর্যায়ে, এমন কী ফরমালিন ও ডিটারজেন্ট পাওডারের উপস্থিতিও পাওয়া গেছে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়।
গত ২৫ জুলাই পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুককে হুমকি দেয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুধের ভেজাল নিয়ে আইসিডিডিআর,বি এর গবেষণার পরপরই আদালতে রিট করেছিলেন এক আইনজীবী। আর অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে নতুন করে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতির খবরে হৈচৈ শুরু হয়।
তার মধ্যেই আদালতের নির্দেশে দুধের অধিকতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরি, বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ, আইসিডিডিআর,বি ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের ল্যাবরেটরি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। তাতে নতুন তথ্য আসে, দুধে ক্ষতিকার মাত্রায় পাওয়া গেছে ভারী ধাতু সীসা ও ক্যাডমিয়াম। এ যেন আরেক আতংক।
তবে সীসা এবং ক্যাডমিয়াম গাভীতে কোন খাদ্যাউপাদান বা ওষুধের মাধ্যমে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দীর্ঘদিনের পরিবেশ দুষণই এর বড় কারণ বলেও মনে করেন তারা।
তবে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি নিয়ে তৈরি হয়েছে ধুম্রজাল। লিভোফ্লক্সাসিন ও এনরোফ্লক্সাসিন প্রাণি চিকিৎসায় ব্যবহার হয় না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে পোল্ট্রিতে এর ব্যবহার রয়েছে। তাহলে এই এন্টোবায়োটিক কীভাবে দুধে পাওয়া গেলো তা নিয়ে বিষ্ময় কাটছে না অনেকেরই। আর এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি মানেই দুধ পানযোগ্য নয় তা বলারও সুযোগ নেই। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ এডমিনিস্ট্রেশনের গাইডলাইন অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট মাত্রার এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি গ্রহণযোগ্য যাকে বলা হয় ম্যাক্সিমাম রেসিডিউ লিমিট বা এমআরএল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের গাইডলাইন অনুযায়ী দুধে এনরোফ্লক্সাসিন ও সিপ্রোফ্লক্সাসিনের এমআরএল ০.১ পিপিএম। কানাডিয়ান হেলথ এজেন্সীর গাইড লাইনে অক্সিটেট্রাস্লাইকিনের এমআরএল ০.১ পিপিএম গ্রহণযোগ্য। আর নতুন ড্রাগ লিভোফ্লক্সাসিনের এমআরএল নিয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে দুধে যে এন্টিবায়োটিকের উপস্থিতি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পাওয়া গেলো তা কত মাত্রায় ছিলো। জাতির সামনে এটি কিন্তু কেউ পরিষ্কার করছেন না।
কারো উদ্দেশ্যই কোন শিল্পকে ধ্বংস করা নয়, বরং শিল্পটিকে আরো নিরাপদ করাই সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত। যেমনটা হয়েছিলো জাপানে। জাপানের মরিনাগা মিল্ক ইন্ডাস্ট্রির আর্সেনিকযুক্ত দুধের খবর ওকায়ামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রথম প্রকাশিত হয়। সেটি ১৯৫৫ সালের ঘটনা। গবেষণায় পাওয়া যায়, তাদের শিশুরা মরিনাগা কোম্পানির যে দুধ খাচ্ছে, যে দুগ্ধজাত ফর্মুলা মিল খাচ্ছে, তাতে রয়েছে আর্সেনিক বিষ। সেই গবেষণা জাপানি শিশুদের বাঁচাতে সহায়তা করেছিলো। বাংলাদেশে দুধে এন্টিবায়োটিক হয়তো নিরাপদ দুধ উৎপাদনের পথ সুগম করতে পারে। যদিও খাদ্যে ভেজাল দেয়া এবং খাওয়া এ জাতির জন্য এমন প্রত্যাশাপূরণ কঠিনই বটে!
তর্ক-বির্তকের মধ্যেই রোববার উচ্চ আদালত ১৪টি কোম্পানির পাস্তুরিত দুধ বিক্রি পাঁচ সপ্তাহের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে যদি দোষী প্রমাণিত হন দুধ কেলেংকারির হোতারা তাহলে কী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে?
২০০৮ সালে চীনে গুঁড়া দুধে মেলামাইন কেলেঙ্কারির কথা অনেকেরই মনে আছে। মেলামাইনের বিষক্রিয়ায় চার শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় শাস্তি পাওয়া আটজনের দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।
মেলামাইন পাওয়া গুড়া দুধ সানলুর উৎপাদন বন্ধ করে দেয়া হয়। ধ্বংস করা হয় কোম্পানিটির সব মজুদ। আরো বিস্ময়কর, কোম্পানির যে কর্মচারীর হাতে প্রথম এ মেলামাইন মিশ্রণের বিষয়টি ধরা পড়ে, পরে তাকে রহস্যজনকভাবে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।
অনেকে চীনের দুধ কেলেঙ্কারিতে ‘কালচার অব সিক্রেসি’ বা গোপনীয়তার সংস্কৃতিকে দায়ী করেন। বাংলাদেশের ভোক্তারাও এখন সচেতন। তাদের প্রত্যাশা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার সঠিক তথ্য জানুক সবাই, আতংক না ছড়িয়ে নিশ্চিত করা হোক নিরাপদ দুগ্ধ উৎপাদন।
শুরুতেই যে শ্বেত বিপ্লবের কথা বলছিলাম, তা নিশ্চয় এখন বলতে হবে নিরাপদ শ্বেত বিপ্লব। গ্রামীণ অর্থনীতি ও নারীর ক্ষমতায়নকেও বেগবান করবে এই বিপ্লব। কারণ পল্লী অঞ্চলের ৭০ শতাংশের বেশি পরিবারে পশুপালন করে থাকে যার আবার ৭০ শতাংশই হচ্ছেন নারী। আর জাতীয় জিডিপিতে সাড়ে ৩ শতাংশ অবদান রাখছে ডেইরি শিল্প, বলছে শিল্পটির এসোসিয়েশন। ইতোমেধ্যই সারা দেশে গড়ে উঠেছে প্রায় ১২ লাখ খামার।
গুড়া দুধ উৎপাদনকারী বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব গুজব না বাস্তবতা তার চেয়ে বড় বিষয় দুধ সংকট থেকে পরিত্রাণ চায় মানুষ। সুস্থ দেহ, সুস্থ জাতির জন্য নিরাপদ দুধের যেমন প্রয়োজন, তেমনি উন্নয়নশীল দেশের অগ্রযাত্রায় গ্রামীণ অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার জন্য প্রয়োজন শিল্পটির বিকাশে সঠিক পদক্ষেপ ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা।
পরিশেষে অষ্টাদশ শতকের কবি ভারতচন্দ্রের সেই কবিতা “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে” সময়ের দাবিতে সংস্কার করে বলতে চাই “আমার সন্তান যেন থাকে নিরাপদ দুধে-ভাতে”।