ড. ইন্দ্রাণী ধর : ১৯৬৪ সালের ’’ঢাক্কা ফিভার’’ দিয়ে শুরু হয় ভাইরাসঘটিত ডেঙ্গু জ্বর, ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু জ্বরের মহামারি কঠিন আউটব্রেক হয়। সেই বছর ৯৩ জনের মৃত্যু এবং তৎপরবর্তী বছরগুলোতে থেমে থেমে জ্বরের প্রকোপসহ মৃতের সংখ্যা কমবেশী হওয়ার মাধ্যমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি অনেকটা সহনশীল ছিল।
তবে ২০১৯ সালের ডেঙ্গু পরিস্থিতি সত্যিই উৎকণ্ঠা পর্যায়ে, তার কারণ হিসেবে বলা যায়:
১. ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ও ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া জুলাই’১৯ পর্যন্ত নথিভুক্ত রোগীর সংখ্যা ১৩,৬৩৭ জন প্রায়);
২. আক্রান্ত রোগীর মধ্যে শিশুদের হার তুলনামূলক বেশি হওয়া.;
৩. শিশু ও ডাক্তার সহ বিভিন্ন বয়সী ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুবরণ করা;
৪. ডাক্তারসহ নাগরিকদের উদ্বেগ উৎকন্ঠা বৃদ্ধি পাওয়া;
ডেঙ্গু প্রকোপের কারণ:
১. Aedes aegypti (প্রধান ভেক্টর) ও Aedes albopictus মশা (যারা অন্যান্য মশার তুলনায় দেখতে কালো, মাথায় দুটো সাদা কাস্তে আকৃতির/সাদা লাইন ও পায়ে সাদা ছোপ যুক্ত) ডেঙ্গু জ্বরের ভেক্টর (Dengue virus (DENV: Flavivirus বহনকারী) এর জন্য এ বছর বংশ বিস্তারের অনুকূল আবহাওয়া (ফেব্রুয়ারি-জুলাই’১৯ পর্যন্ত থেমে থেমে বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি) বিরাজমান থাকায় জ্যামিতিক হারে Aedes মশা বৃদ্ধি পাওয়া।
২. তাপমাত্রা অনুকূলে থাকার ফলে আগের চাইতে দ্রুততম সময়ে Aedes মশা তার জীবনচক্র সম্পন্ন করার প্রবণতা (যেহেতু ১৯৯৭ সাল থেকে ডেঙ্গু নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছি, তাই প্রতিবছরই ডেঙ্গু শুরু হওয়ার সময় চেষ্টা করি ছোটখাটো একটা স্টাডি করার সে মোতাবেক এ বছর মে মাসের প্রথম দিকে স্টাডি করেছি লালমাটিয়া ও আগারগাঁও এ Ovitrap (ডিম পাড়ার ফাঁদ: পানিযুক্ত কাঁচের ও মাটির পাত্র) এর মাধ্যমে। স্টাডি থেকে যেটি দেখা গেল পূর্ববর্তী বছরগুলো থেকে কম সময়ে অর্থ্যাৎ আগে যেখানে ৪-৫ দিন সময় লাগতো ডিম থেকে লার্ভা (অপরিণত দশা: যা মূলত পরিস্কার পানিতে থাকে, ওখান থেকে খাবার সংগ্রহ করে) বের হতে এখন সময় লেগেছে ৩/৪ দিন (অর্থ্যাৎ জীবনকাল কমিয়ে আনা) যা, তাদের দ্রুত বংশবৃদ্ধির একটা অন্যতম কারণ।
৩. বাসা বাড়ি (বর্তমান সময়ে নির্মিত বহুতল ভবনের নকশা; যার সম্মুখ পিছনে বা ছাদে বাগানের ব্যবস্থা রাখা এবং ইন্ডোর প্ল্যান্টের ব্যবহার, বৃষ্টির পানি তথা পরিস্কার পানি জমার সুযোগ সৃষ্টি ও ভবন নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ড্রাম/চৌবাচ্চা মাধ্যমে মশা প্রজনন স্থান বৃদ্ধি পাওয়া।
৪. মানুষের ফুড হেবিটের (অপঁচনশীল কৌটা/প্লাস্টিকের ব্যবহার বৃদ্ধি পরিবর্তন) হওয়া ও আন্ত:জেলায় যাতায়াত বৃদ্ধি পাওয়া।
৫. সর্বোপরি নতুন DENV সেরোটাইপ [ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরোটাপের (DEN-১,২,৩ ও ৪) মধ্যে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১ ও ২’র আধিক্য ছিল] ৩/৪ এর আগমন হওয়া।
আমার পিএইচডি গবেষণার সময়কাল (২০১৫-১৭) পর্যন্ত ঢাকা শহরের ৬টি জায়গায় (ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, ফার্মগেট, মিরপুর, গুলশান ও আজিমপুর) রেনডমলি সিলেকটেট বাড়ি থেকে সরাসরি অ্যাডিস মশা (Aedes aegypti ও Aedes albopictus) কালেকশন করা হয়। যার মধ্যে সর্বোচ্চ মশা (১৯.৮৩%) পাওয়া যায় ফার্মগেইট থেকে এবং এদের ১৩.৩১% ই ছিল Aedes aegypti প্রজাতিটি।
পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজী ল্যাবে ঐ মশা থেকে ডেঙ্গু ভাইরাস (AEDES) সেরোটাইপ সনাক্ত করা হয়। ৬টি জায়গায় পূর্ণাঙ্গ DENV মশা থেকে ৪টি জায়গায় (ধানমন্ডি, ফার্মগেইট, মিরপুর ও আজিমপুর) ডেঙ্গু সেরোটাইপ ১ ও ২ সনাক্ত হয়। যা থেকে বুঝা যায়, ঢাকা শহরের বেশিরভাগ ওয়ার্ডের মশা ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত।
ব্যাক্তি/ সামগ্রিক পর্যায়ে করণীয়:
মশার প্রজনন স্থান চিহ্নিতকরণ ও ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সরকার থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায় পর্যন্ত সবাই জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। ২০০০ সালেই এটি প্রমাণিত যে, প্রজনন স্থান (বোতল, হাঁড়ি, ভাঙ্গা জিনিসপত্র পানি জমতে পারে এমন পাত্র, ড্রাম, চৌবাচ্চা, সিমেন্টের গর্ত) ধ্বংসকরণ/ উল্টে দেয়ার মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা হলো প্রতিরোধের অন্যতম উপায়।
তাই এই মূর্হুতে ডেঙ্গু প্রতিরোধক টাস্কফোর্স তৈরি করা এবং সাথে সাথে কীটতত্ত্ববিদদের তত্ত্বাবধানে সার্ভে পরিচালিত করে ডেঙ্গু প্রবণ এলাকাতে ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া। ব্যক্তি পর্যায় ঘর/বাড়ির আশেপাশে/ভিতরে উল্লেখিত পাত্রগুলোতে যাতে পানি জমে না থাকে, সেগুলোর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা। সকাল (১১ পর্যন্ত) ও বিকালে (৪ – ৬.৩০টা) যাতে শরীরে মশা বসতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং লংস্লিপ ড্রেস পরিধান করা। জ্বর হলেই আতংকিত না হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিজেকে ভালো রাখার ব্যবস্থা করা।
১. প্রতিটি ওয়ার্ডে ১০-১৫ জন লোকবল নিয়োগ করা, যাদের মধ্যে এক একদল পরিস্কারের কাজ চালাবে, অন্যদল পানি জমেছে কিনা কোথাও সেটার ওপর নজর রাখবে।
২. প্রতিটি জোনের জন্য টীম গঠন করা টাস্কফোর্স টীমটি ৫-৮ জনের হতে পারে, যারা সব ধরনের সরঞ্জাম নিয়ে (গাড়িসহ) কোন জায়গায় ডেঙ্গুর খবর পাওয়া গেলে অতি দ্রুত সেখানে পৌঁছে DENV লাভা/পূর্ণাঙ্গ মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে।
৩. পানি জমে থাকা ভবনগুলো পরিস্কার করে দেয়ার খরচ বাবদ বিল, বাড়ির বার্ষিক করের বিলের সংগে/অথবা অন্যভাবে জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থা করা।
৪. প্রত্যেক ওয়ার্ডে একজনকে দায়িত্ব দেয়া যার কাজ হবে ওই এলাকায় যতো হাসপাতাল, নার্সিং হোম বা ডায়াগনোস্টিক সেন্টার আছে, সেখান থেকে ডেঙ্গু সংক্রান্ত তথ্য কালেকশন করা।
৫. বিভিন্ন মিডিয়াকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই নাগরিককে ডেঙ্গু সম্পর্কে সচেতন করার উদ্যোগ নেয়া।
৬. মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য ব্লাড স্যাম্পলগুলোকে নির্দিষ্ট জায়গায় পাঠানোর মাধ্যমে টেস্ট করার ব্যবস্থা রাখা।
৭. ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ নিতে ম্যানেজম্যান্ট কমিটি (ডাক্তার, কীটতত্ববিদ ও (স্টক হোল্ডারের সমন্বয়ে) গঠনের মাধ্যমে যারা প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করবেন।
লেখক: সহকারি অধ্যাপক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কীটতত্ববিদ ও ডেঙ্গু গবেষক।