মো. খোরশেদ আলম (জুয়েল): শিল্পসমৃদ্ধ নগরী রূপগঞ্জ। রাজধানী ঢাকার কোলঘেঁষা একটি অঞ্চল। এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় ২০০টির অধিক পোলট্রি ফার্ম। এসব পোলট্রি ফার্ম থেকে দৈনিক ১০০ টনের অধিক বিষাক্ত বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিতভাবে এসব বর্জ্য যত্রতত্র ফেলার ফলে দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল রূপগঞ্জবাসী। দুর্গন্ধে শিশু ও বৃদ্ধরা হাঁপানিসহ ভয়াবহ রোগে আক্রান্ত হচ্ছিল। দুর্গন্ধ ও রোগের হাত থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে অনেক উদ্যোগ ভেস্তে যাওয়ার পর রূপগঞ্জবাসীর জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে বায়োগ্যাস প্লান্ট। এক একটি বায়োগ্যাস প্লান্টে দৈনিক বিষ্ঠা প্রয়োজন প্রায় ১০০ কেজি। যা থেকে উৎপন্ন গ্যাস দিয়ে দৈনিক ১২-২৫ জন লোকের তিন বেলা রান্না হচ্ছে। বায়োগ্যাস প্লান্টের সুবিধাজনক দিকগুলো দেখে সাধারণ মানুষ এর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এরই মাঝে রূপগঞ্জে গড়ে ওঠা পোলট্রি ফার্মের বিষাক্ত বিষ্ঠানির্ভর বায়োগ্যাস প্লান্টের সংখ্যা সাড়ে তিনশ’ ছাড়িয়েছে। যার সুবিধা ভোগ করছে প্রায় ৮০০ পরিবার। একেকটি বায়োগ্যাস প্লান্টে দৈনিক ৭০-১৫০ কেজি মুরগির বিষ্ঠা প্রয়োজন হয়। বিষ্ঠার প্রায় সম্পূর্ণ অংশই ব্যবহৃত হচ্ছে এই বায়োগ্যাস প্লান্টে।
বাংলাদেশের পোলট্রি এখন আর উঠতি কোন শিল্প নয় বরং প্রতিষ্ঠিত একটি শিল্প। বছর বছর বাড়ছে এর পরিধি। বর্তমানে দেশে পোলট্রি শিল্পে ৩০ হাজার কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ রয়েছে এবং ২০৫০ সনে সেটির পরিমাণ দ্বিগুণ হবে বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করছে সংশ্লিষ্টগণ। পোলট্রি তাই কেবল ব্রয়লার মুরগির মাংস ও ডিম খাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। মাংস ও ডিম দিয়ে প্রক্রিয়াজাত খাবার ভোক্তাদের টেবিলে পৌঁছে দেয়ার জন্য গড়ে উঠছে বিভিন্ন প্রসেসিং প্লাণ্ট। ইতোমধ্যে তারা দেশের বাজারে বিপণনের পাশাপাশি বিদেশের বাজারে প্রবেশের চেষ্টাও করছেন। তারমানে, পোলট্রি বর্জ্য কেবল এখন আর পোলট্রি লিটারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং প্রসেসিং প্লাণ্ট থেকেও মুরগির নাড়ী, ভূড়ি, পাখনা ইত্যাদির বর্জ্য বাড়ছে। তবে সুখবর হলো এসব কারখানা থেকে উৎপাদিত বর্জ্য কাজে লাগানো হচ্ছে কিংবা কাজে লাগানোর সুযোগ আছে। তবে সেগুলো কীভাবে?
পোলট্রি কিংবা মৎস্য ফিড তৈরির জন্য একটি অত্যাবশকীয় উপাদান হলো প্রোটিন মিল। বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রোটিন মিল আমদানি করা হয় এসব ফিড তৈরির জন্য। এতদিন প্রোটিন মিলের সোর্স হিসেবে এমবিএম আমদানি করে চাহিদা মেটানো হতো। কিন্তু এমবিএম আমদানি নিষিদ্ধ থাকার দরুন এ খাতের শিল্পোদ্যোক্তারা পড়েছেন বিপাকে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, পোলট্রি প্রক্রিয়াজাত কারখানা থেকে উৎপাদিত বর্জ্য (নাড়ী, ভূড়ি ও অন্যান্য অংশ) থেকে প্রোটিন মিল তৈরি করা যায়। সেই প্রোটিন মিল এমবিএম এ বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে পোলট্রি খাদ্য তৈরিতে সেগুলো ব্যবহার করা যাবেনা কিন্তু ফিস ফিড তৈরিতে যাবে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, দেশের কিছু কিছু কোম্পানি সেসব প্রোটিন মিল দিয়ে নিজেদের কারখানায় ফিস ফিড তৈরি কাজে ব্যবহার করছে। এর ফলে পরিবেশ দূষণ যেমন কমছে তেমনি সাশ্রয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, এসব চিকেন বর্জ্যে ৫৩% ক্রুড প্রোটিন ও ৩২% ক্রুড লিপিড বিদ্যমান।
গবেষণায় দেখা গেছে, পোলটি্র খামারের ৩১ শতাংশ মালিক বর্জ্য পুকুরে ফেলেন, ১৬ শতাংশ বর্জ্য পরিশোধন না করেই জমিতে ফেলা হয় আর ৮১ শতাংশ মালিক বর্জ্য ফেলার আগে পরিশোধন করেন না। মাত্র ৩ শতাংশ মালিক বায়োগ্যাস এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করেন। বেশ কিছু বড় বড় কোম্পানি ইতিমধ্যে তাদের ফার্মের বর্জ্য দিয়ে সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং বাইপ্রোডাক্ট জৈব সার হিসেবে বাজারজাত করছে। এর ফলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন খরচ যেমন কমছে তেমনি পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখছে। অন্যান্য কোম্পানিগুলোরও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসা উচিত।
সমগ্র বিশ্বের মতো বাংলাদেশও পোলট্রি বর্জ্যের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বর্তমানে একটি চিন্তার বিষয়। পোলট্রিকে বলা দেশের কৃষি খাতের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল একটি উপখাত। ছোট-বড় প্রায় ৬৫-৭০ হাজার পোলট্রি ফার্মের সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকার দরুন একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণ বাড়ছে তেমনি পোলট্রি রোগবালাইয়ের উপযুক্ত ক্ষেত্রও তৈরি হচ্ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নিত্য নতুন রোগের প্রকোপ ও চ্যালেঞ্জ। ব্যবসায়িক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি শিল্পটিকে রোগবালাইয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
দেশে পোলট্রি খামারের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। বছরে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে এই শিল্পে প্রবৃদ্ধি ঘটছে। আমিষের চাহিদা পূরণে পোলট্রি ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের বেশিরভাগেরিই হাঁস-মুরগি পালনের বিষয়ে বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণই নেই। দেশে এখনো পোলট্রি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। অধিকাংশ পোলট্রি-মালিক জানেনই না, পোলট্রি বর্জ্য কতোটা ক্ষতিকর। আইনগত বাধ্যবাধকতা ওতটা জোরালো নয়। সে কারণে নদী, জলাশয়, রাস্তার পাশে পোলট্রি বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। প্রকৃতি, পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। রোগ-ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে।
দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক আইনগুলো যুগোপযোগী নয়। সেগুলো রয়েছে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। আইনে এক বছরের জেল এবং ৫০ হাজার টাকার জরিমানার কথা আছে। যা এই যুগে চলে না। এত সামান্য জরিমানা, জেল অপরাধীদের জন্য যথেষ্ট নয়। তবে আইনের চেয়ে জরুরি খামারিদের সচেতন করে তোলা। এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচার-প্রচারনা চালানো দরকার। সরকারি-বেসরকারি উভয়পক্ষকেই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে।
মনে রাখতে হবে, শিল্প বড় হওয়া মানেই টেকসই হওয়া নয়। টেকসই পোলট্রি শিল্প এবং রপ্তানি বাজারকে কাজে লাগাতে গেলে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের কার্যকর নজর দিতে হবে।