কথায় আছে Seeing is believing নিজের চোখে দেখার মত আর অন্য কিছুতেই যেন বিশ্বাসযোগ্যতা আসে না। পোল্ট্রি শিল্প সম্পর্কে নানা জনের নানান ভুল ধারনা আছে। এদেশের পোল্ট্রি শিল্প যে কতটা অগ্রগতি লাভ করেছে তা বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা। এমনকি দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পের উপর তৈরি করা ভিডিও ডকুমেন্টারি দেখার পরও অনেক বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা প্রথম দেখায় মনে করেন এগুলো হয়ত বিদেশের ছবি। যখন ভুলটি ভেঙ্গে দেয়া হয় তখন যেন শুধুই অবাক হওয়ার পালা।
গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীদের কাছে বস্তুনিষ্ঠতার কোন বিকল্প নেই। অন্যের মুখের কথা বিশ্বাস করার সুযোগ নেই এ পেশায়। তাইতো পোল্ট্রি শিল্প সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট করতে হলে সরেজমিন পরিদর্শনের যে কোন বিকল্পই নেই! সে বাস্তবতাকে গুরুত্ব দিয়েই বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) গত বছরের ন্যায় এবারও গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের জন্য ফিল্ড ট্রিপের আয়োজন করেছিল। এবারের ফিল্ড ট্রিপটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯-২০ নভেম্বর তারিখে। এতে অংশ নেন ইনডিপেন্ডেন্ট টিভি, চ্যানেল-২৪, এনটিভি, যুগান্তর, জনকন্ঠ, দি ডেইলি অবজারভার, দেশ রূপান্তর, দি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, দি নিউজ টুডে এবং ভোরের কাগজের মোট ১২ জন প্রতিবেদক।
১৯ নভেম্বর শহরের কোলাহল থেকে বেরিয়ে ঢাকার অদূরে সাভারের হোপ সেন্টারে হয় রাত্রী যাপন। গত বছর অবশ্য রাত্রীযাপন হয়েছিল গাজীপুরের আরশি নগর রিসোর্টে। পোল্ট্রি যেহেতু স্পর্শকাতর একটি শিল্প তাই রোগজীবাণুর সংক্রমণ রোধে কিছু সতর্কতা মেনে চলতেই হয়। বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খামার পরিদর্শনের আগের তিন দিনের মধ্যে কোন বাণিজ্যিক খামার বা পশুপাখির বাজারে যাওয়ার বিধি-নিষেধ রয়েছে। আগের দিন ঢাকার বাইরে সাংবাদিক বন্ধুদের নিয়ে যাওয়ার পেছনেও এটি অন্যতম একটি কারণ। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়া, আগের দিন থেকেই ঠিকমত গোসল করা, পরিচ্ছন্ন জীবানুমুক্ত কাপ ব্যবহার করা, আইসোলেটেড থাকা- এগুলো যেন নিশ্চিত করা যায় সে নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল আগেই। পরের দিন সকালেই গোসল করে বেরিয়ে পড়া এবং খামারের প্রবেশ মুখে একাধিকবার জীবাণুনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে জীবাণুমুক্ত হওয়া, সেই সাথে প্রবেশমুখেই অন্তত: দুইবার গোসল ও প্রতিবার পরিস্কার নতুন কাপড় পরিধান করা এবং প্রতিটি মুরগির শেডে প্রবেশের আগে আবারও গোসল করা- এটাই নিয়ম আধুনিক বড় পোল্ট্রি খামারগুলোর।
এবারের ফিল্ড ট্রিপটি পড়েছে শীতকালে- যা কিনা ‘বার্ড-ফ্লু’ সিজন হিসেবেই খামারিদের কাছে অধিক পরিচিত। তাই আগে থেকেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিল বাণিজ্যিক পোল্ট্রি খামারে প্রবেশের সুযোগ এবার মিলছে না। সাধারণত এই সিজনে খামারের কর্মীদেরকেও মৌসুমের ৩ থেকে ৪ মাস খামারের ভেতরেই অবস্থান করতে হয়। বাইরে থেকেও সাধারণত নতুন কাউকে ঢুকতে দেয়া হয়না। কর্মীদের থাকা, খাওয়া সবকিছুর ব্যবস্থা খামার এলাকার ভেতরেই করা হয়ে থাকে। বিনোদনের ব্যবস্থাও রাখা হয় সেখানে, যাতে তাঁরা মানসিকভাবে সুস্থ্য ও উৎফুল্ল থাকতে পারেন।
এবারের ফিল্ড ট্রিপের মধ্যে ছিল- একটি পোল্ট্রি প্রসেসিং প্লান্ট, একটি ফারদার প্রসেসিং প্লান্ট এবং একটি আধুনিক ফিড মিল।
জানানো হয়েছিল- প্রসেসিং শুরু হবে ভোর ৫টায়। তবে সাংবাদিকদের কথা ভেবে সেদিন সময় কিছুটা পেছানো হলো। সাংবাদিকদের টীম যখন প্রসেসিং প্লান্টে এসে পৌঁছালেন তখন সকাল প্রায় ৮টা। কাজকর্ম শুরু হতে চলে গেলো আরও প্রায় আধা ঘন্টা। কিন্তু তারপর ঘড়ির কাঁটা যেন আর থামতেই চায় না। প্রসেসিং ইউনিট অত্যাধুনিক হওয়ার কারণে বেশ দ্রুত গতিতে একটার পর একটা ধাপ পার হতে লাগল। প্রথমেই মুরগি ঝোলানো, তারপর হালাল পদ্ধতিতে হাতে জবেহ করা, মাথা আলাদা করা, নির্দিষ্ট তাপমাত্রার গরম পানির মধ্য দিয়ে সঞ্চালনা করা, ডি ফেদারিং, ক্লিনিং, নাড়ি ভুড়ি বের করা, ঠান্ডা পানিতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চীল করা… ইত্যাদি।
মজার ব্যাপার হলো প্রতিটি ধাপের জন্য সেকশন এবং রুম আলাদা। এক ঘরে মুরগি রিসিভ করা হচ্ছে, হ্যাঙ্গারে মুরগি ঝোলানো হচ্ছে। পাশের ঘরে জবেহ হচ্ছে, রক্ত ঝরার জন্য দীর্ঘ স্টীল প্লেটের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে হ্যাঙ্গারের চেইন। পাশের ঘরে ডি ফেদারিং ও ক্লিনিং। পরের ঘরে নাড়ি ভুড়ি বের করে ফেলা হচ্ছে, সেই সাথে কলিজা, পাকস্থলী আলাদা করা হচ্ছে। এরপর বিশাল চীলার মেশিনে ঠান্ডা পানিতে মাংস চীল করা হচ্ছে। পাশের কক্ষে মুরগির বিভিন্ন অংশ আলাদা করা হচ্ছে। আলাদা আলাদা অংশ প্যাকেট করা হচ্ছে। ঘরের মাঝের দেয়ালগুলো কাঁচের তৈরি হওয়ায় কিছুটা সুবিধা হচ্ছে বটে, তবে তাতে চোখে দেখার পরিপূর্ণ তৃপ্তি মেলে না। তাই সাংবাদিক বন্ধুরা ছুটছেন এক ঘর থেকে অন্য ঘরে।
শেষের ঘরের এক কোনে একটি মেশিন দেখে একজন জিজ্ঞাসা করলেন, ওটা কী? জানানো হলো ওটা একটা মেটাল ডিটেক্টর। মাংসে হেভিমেটালের উপস্থিতি সনাক্ত করতে সেটি ব্যবহার করা হয়। দেখানো হলো কীভাবে পোল্ট্রি মুরগির মাংস বাজারে ছাড়ার আগে হেভিমেটাল টেস্ট করা হয়। এরপর তা নেয়া হয় প্রথমে ফ্রিজার রুমে- যেখানে শূণ্য থেকে ৪ ডিগ্রী তাপমাত্রায় মুরগির মাংস নির্ধারিত সময় পর্যন্ত ঠান্ডা করার পর তা গ্রাহকের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। যে মাংসগুলো বেশি দিন সংরক্ষণ করতে হয় সেগুলো নেয়া হয় ব্লাস্ট ফ্রিজারে। যারা এ ধরনের ড্রেসিং চিকেন বা মুরগির বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদাভাবে কিনে থাকেন সেই সব প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা নিয়মিতভাবেই থাকেন প্রসেসিং প্লান্টে- পণ্যের মান নিশ্চিত হওয়ার জন্য। বিশেষত: যে ধরনের স্পেসিফিকেশন দেয়া হয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা না হলে বাতিল হবে নির্দিষ্ট চালানটি।
পোল্ট্রি প্রসেসিং দেখতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হলো টেলিভিশন চ্যানেলের ভিডিও রিপোর্টারদের কারণ স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই তাঁদেরকে ভিডিও ধারণ করে এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে ছুটতে হচ্ছিল। এদিকে হাতের মোবাইল ক্যামেরায় সেলফি তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছিলেন অন্যরা। বাংলাদেশে যে এমন উন্নতমানের প্রসেসিং ইউনিট থাকতে পারে তা অনেক সাংবাদিক বন্ধুরই আগে জানা ছিলনা। তাই নিঃসঙ্কোচ প্রশংসা করতেও পিছপা হলেন না তাঁরা।
সকালের নাস্তা সেরে এরপর সাংবাদিকদের দলটি গেলেন ফারদার প্রসেসিং প্লান্টে। প্রসেসিং ইউনিটের মত এবারও তাঁদের গায়ে এ্যাপ্রোন, মাথা ও নাকে মাস্ক, পায়ে গামবুট পরে তবেই প্লান্টে প্রবেশের অনুমতি মিলল। চিকেন নাগেট ও পরাটা তৈরি দেখলেন তাঁরা। সেদিন যেহেতু অন্য খাবারের অর্ডার ছিলনা তাই ভাগ্য কিছুটা মন্দই বলা চলে। ফারদার প্রসেসিং ফুডের দীর্ঘ তালিকার বেশিরভাগ আইটেম দেখার সুযোগ হলো না সেদিন। তবে প্লান্ট ভিজিট শেষে ওয়েটিং রুমে বসার কিছুক্ষণ পর থেকেই একটার পর একটা মজাদার খাবার গামলায় আসতে থাকলো। প্রথমেই এলো ডাল পুরি, এরপর চিকেন সসেজ, এরপর চিকেন সামুচা, তারপর চিকেন নাগেট, …। যা আসছিল নিমিষেই সাবাড় হচ্ছিল। আরও স্বাদ গ্রহণ করতে হলে সময় দিতে হবে। কিন্তু আমাদের সে সুযোগ নেই। যেতে হবে গাজীপুরের মাওনার নিকটবর্তী বানিয়ারচালা ইউনিয়নে। সেখানে ফিড মিল অপেক্ষা করছে আমাদের। তাই তো দেরি না করে ছুটল সাংবাদিকের দল। সেখানে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বেলা প্রায় দু’টা। বিশাল ফিড মিল। তাই খাওয়া দাওয়া সেরেই ফিড মিল পরিদর্শনে যাওয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে করলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
এখানে সবকিছুই স্বয়ংক্রীয়। বাছাইকৃত কাঁচামালগুলো আগেই সাইলোতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এরপর বিভিন্ন বীন থেকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে দেয়া নির্দেশনায় অটোমেটিকভাবে বিভিন্ন উপকরণ চলে আসে সেন্ট্রাল বীনে। প্লান্ট ম্যানেজার ডায়াগ্রাম দিয়ে দেখালেন কিভাবে প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো আসছে এবং ফিনিসড প্রোডাক্ট হিসেবে বেরিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলছিলেন মানুষের খাবার তৈরিতে যে ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা হয়, মুরগি ও মাছের খাবার তৈরিতে সতর্কতা তারচেয়ে কোন অংশে কম নয় বরং বেশিই।
প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো ব্যবহারের আগেই নিজস্ব ল্যাবে টেস্ট করা হয়, কারণ সামান্য একটু হেরফের হলেই ফিডের মানে কম-বেশি হবে এবং কাঙ্খিত আউটপুট পাওয়া যাবেনা। ফিড তৈরির সময়কালে মাছ ও মুরগির খাবার আবারও টেস্ট করা হয়- ঠিকমত স্টীমড হয়েছে কীনা, ঠিকমত হজম হবে কীনা, ম্যাক্সিমাম বেনিফিট বা গ্রোথ আসবে কীনা ইত্যাদি বিষয়গুলো নিশ্চিত হওয়ার জন্য। সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাও ফিডের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। এর পাশাপাশি প্রতিটি ব্যাচের স্যাম্পল আলাদা আলাদাভাবে সংরক্ষণ করা হয়, যাতে বাজারে কোন ব্যাচের ফিডের ব্যাপারে অবজেকশন এলে তা সহজে স্বল্পতম সময়ের মধ্যেই যেন পুনরায় পরীক্ষা নিরাক্ষা করে সঠিক কারণ অনুসন্ধান এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। ফিড মিলে ঢোকার মুখে অনুষ্ঠিত হলো একটি ছোটখাটো ফটো সেশন। মাথায় হেলমেট আর নাকে মাস্ক পরা সাংবাদিক বন্ধুদের দেখে যেন চেনাই যাচ্ছিল না।
জানা গেল ফিড মিলের কাছেই রয়েছে জারবেরা ফুল আর ড্রাগন ফলের বাগান। তাই দেরি না করে দ্রুতই বেরিয়ে পতে চাইলেন সাংবাদিক বন্ধুরা। সূর্যের আলো কমতে শুরু করেছে, ঢলে পার আগেই দু’চোখ ভরে ফুলের সৌন্দর্য্য উপভোগ করার আকাঙ্খা তখন সবার চোখেমুখে।
বাগান থেকে আমরা বেরিয়ে এসেছি। সূর্য হেলে পড়েছে। আমাদের মাইক্রোবাসটিও ফেরার পথ ধরেছে। ভোর থেকে শুরু হওয়া কর্মব্যস্ত দিনটি শেষ হতে এখনো ঢেড় বাকি কারণ গাড়ির জ্যাম ঠেলে ঢাকায় ঢুকতে ক’টা বাজবে তা হলফ করে বলা মুশকিল।
লেখক: মো. সাজ্জাদ হোসেন, যোগাযোগ ও মিডিয়া উপদেষ্টা, বিপিআইসিসি।