সালাহ উদ্দিন সরকার তপন: মাছ চাষে বায়োফ্লক, ট্যাংক কালচার ও আরএএস এ তিনটি পদ্ধতি বর্তমানে একটি আলোচ্য বিষয়। সাদা চোখে বিষয়টি অনেকের কাছে কাছাকাছি পদ্ধতি মনে হলেও এগুলোর মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। তবে এই তিনটি পদ্ধতিতে একটি ব্যাপার মিল আছে এবং সেটা হচ্ছে এগুলো শতভাগ বিদ্যুৎ নির্ভর পদ্ধতি। আমার আগামী লেখাগুলো হবে বায়োফ্লক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। তবে বায়োফ্লকের কাছাকাছি ট্যাংক কালচার ও RAS পদ্ধতিতেও যেহেতু অনেকে মাছ চাষ করে থাকেন, তাই বায়োফ্লক নিয়ে আলোচনা আগে এই তিনটি পদ্ধতিতেই মাছ চাষ করার উপর একটি তুলনামূলক আলোচনা করা সমীচীন করা মনে করছি।
ট্যাংক কালচার
এই পদ্ধতিতে সারাক্ষণ একদিক থেকে পানি সরবরাহ করতে হবে ট্যাংকে, অন্যদিকে ট্যাংকের নিচের দিক দিয়ে মাছের বিষ্ঠাসহ পানি বেরিয়ে যেতে থাকবে। এটি খুবই সহজ একটি চাষ পদ্ধতি হলেও প্রচুর পানির অপচয় হয়। ট্যাংক কালচারে শিং-কৈ বা এই জাতীয় মাছ ছাড়া অন্য মাছ চাষ করলে যাদের অক্সিজেন দরকার হয়, তখন ট্যাংকে ব্লুয়ার দিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এটা শতভাগ সম্পূরক খাদ্য নির্ভর চাষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে চাষ করতে গেলে অবশ্যই মাটির নিচের পানির পিএইচ ৭.২ থেকে ৭.৫ হতে হবে। তা না হলে মাটির নিচ থেকে পানি তুলে অন্য একটি ট্যাংকে পানিটা রেখে তার পিএইচ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে আনার জন্য ট্রিট্ম্যান্ট করতে হবে। এরপর সেটা চাষের ট্যাংকে দিতে হবে, এতে বিদ্যুৎ বিল বেঁড়ে যাবে। সরাসরি মাটির নিচের পানি ব্যবহার করতে চাইলে, যদি পিএইচ কম থাকে তাহলে নিশ্চিত থাকুন আপনার মাছ ক্ষত রোগে আক্রান্ত হবে ঘন ঘন। এই পদ্ধতির চাষে মাছের রোগ মোকাবেলায় এন্টিবায়োটিক এবং বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, অনেকটা ক্যামিক্যাল নির্ভর মাছ চাষ বলা যায়, কোন প্রোবায়োটিক ব্যবহার হয়না। এই পদ্ধতির মাছ চাষে তিনটি পদ্ধতির চাষের মধ্যে মাছ উৎপাদনে তুলনামূলক বেশি খাবার লাগবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিটন পানিতে ৩০-৪০ কেজি তেলাপিয়া মাছ উৎপাদন করা যায় (আমরা ধরে নিলাম তেলাপিয়া মাছ), ক্ষেত্র বিশেষে মাছের প্রজাতি ভেদে কম বেশিও হতে পারে। ট্যাংক কালচার আর বায়োফ্লক কালচার শুরু করার প্রাথমিক খরচ প্রায় কাছাকাছি।
আরএএস (RAS) পদ্ধতি
RAS পদ্ধতিতে ট্যাংকের পানিটা মেকানিক্যাল ও বায়োফিল্টার হয়ে মাছের বিষ্ঠামুক্ত হয়ে একই পানিকে বার বার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মাছের বিষ্ঠমুক্ত করতে এখানে ৫% পানির অপচয় হয়। এই পদ্ধতিতে বায়ো মিডিয়া (বায়ো ফিল্টার) থাকার কারণে প্রচুর প্রোবায়োটিকের উপস্থিতি থাকে ট্যাংকের মধ্যে। পানি পরিষ্কার সহ জীবাণু মুক্ত রাখতে ও এমোনিয়া মুক্ত করার জন্য মেকানিকে ফিল্টার কার্যকরী ভূমিকা রাখে। পানির গুনগত মান নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরো ব্যবহার করা হয় প্রোটিং স্কিমার, UV ফিল্টার, অক্সিজেন জেনারেটর। এছাড়াও এখানে পানির গুণাগুণ রেকর্ড করার জন্য বিভিন্ন ধরনের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিভাইস সেট করা হয়ে থাকে ক্ষেত্র বিশেষে।
RAS পদ্ধতিতেও শতভাগ সম্পূরক খাদ্য নির্ভর চাষ পদ্ধতি। তথাপি এই পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদনে ট্যাংক কালচার থেকে প্রায় ১০% ফিড কম লাগে। কারণ, এই পদ্ধতিতে প্রোবায়োটিক থাকার কারণে ট্যাংকের মধ্যে এক ধরনের এনজাইমের উপস্থিতি থাকে যা মাছের খাবার হজমে সহায়তা এবং এফসিআর উন্নত করে। বায়োফিল্টারের মাধ্যমে অ্যামোনিয়াও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই পদ্ধতির জন্য দরকার বদ্ধ ঘর যেখানে বায়ো সিকিউরিটি শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। এই পদ্ধতিতে ৩০-৭০ কেজি তেলাপিয়া মাছ উৎপাদন করা যায় (আমরা ধরে নিলাম তেলাপিয়া মাছ), ক্ষেত্র বিশেষে মাছের প্রজাতিভেদে কম বেশিও হতে পারে। তবে এটি খুবই ব্যয় বহুল পদ্ধতি। আমাদের দেশে মাছের দাম কম থাকায় বিনিয়োগের তুলনায় লাভের পরিমান কম হওয়ায় এ পদ্ধতিতে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত মাছ অধিক নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। কারণ, এই পদ্ধতিতে মাছের কোন ধরনের রোগবালাইয়ের জন্য কোন এন্টিবায়োটিক বা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়না। কারণ, শতভাগ বায়োসিকিউরিটি মেনে চলতে হয়।
বায়োফ্লক পদ্ধতি
বায়োফ্লোক প্রযুক্তি মাছ চাষ হলো একটি টেকসই এবং পরিবেশগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ পদ্ধতি, যা পানির গুনমান এবং ক্ষতিকারক রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করে৷ জলীয় খামার ব্যবস্থার জন্য মাইক্রোবায়াল প্রোটিন খাদ্য হিসেবে সরবরাহ করে।
বায়োফ্লক উন্মুক্ত বা আবদ্ধ অবস্থায় ট্যাংকে করা হয়ে থাকে, চাইলে এই পদ্ধতি পুকুরেও করা যায়। বায়োফ্লোক প্রযুক্তির মূলত বর্জ্য পুষ্টির পুর্নব্যবহারযোগ্য নীতি৷ বিশেষ করে নাইট্রোজেন, মাইক্রোবায়াল জৈব বস্তুপুঞ্জের মধ্যে খাবারের খরচ কমাতে এবং মাছের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ‘বায়োফ্লক’ প্রযুক্তি যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করবে।’ এই পদ্ধতিতেও মাছের কোন ধরনের রোগবালাইয়ের জন্য কোন এন্টিবায়োটিক, জীবাণুনাশক ব্যবহার করা হয়না। তবে বায়োসিকিউরিটি মেনে চলতে হয় শতভাগ। বায়োফ্লকে কোন ধরনের ফিল্টার প্রয়োজন হয়না, অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরনের কম পাওয়ারের ব্লুয়ার ব্যবহার করা হয় ২৪ ঘণ্টা। এই পদ্ধতিতে পানি পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না, তাই পানির অপচয় হয়না বললেই চলে। প্রোবায়োটিক/ব্যাকটেরিয়া বায়োফ্লকে সৃষ্ট অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে এবং মাছের বিষ্ঠাকে মাছের খাদ্যে পরিণত করে ফ্লক তৈরির মাধ্যমে। এই ফ্লক মাছের ২০ – ৩০% পর্যন্ত খাদ্যের চাহিদা পূরণকরে থাকে, যার ফলে বলা যায় এই পদ্ধতিতে মাছ উৎপাদনে ২০-৩০% খাবার কম লাগে। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে ৪০% পর্যন্ত (বিশেষ করে তেলাপিয়া মাছ) খাদ্য কম লাগে পুকুর বা ট্যাংক কালচার অপেক্ষা। এই পদ্ধতিতে নিয়মিত প্রোবায়োটিক ব্যবহার করা হয় এবং প্রোবায়োটিকের কার্যক্রম বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনে কার্বন মিডিয়া যোগ করা হয়। পানির পিএইচ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সহজেই। এই পদ্ধতিতে প্রতি টন পানিতে ৩০-৪০ কেজি তেলাপিয়া মাছ উৎপাদন করা যায় (আমরা ধরে নিলাম তেলাপিয়া মাছ), ক্ষেত্র বিশেষে মাছের প্রজাতিভেদে কম বেশিও হতে পারে। এই পদ্ধতিতে উৎপাদিত মাছ নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত।
লেখক: ম্যানেজিং পার্টনার, সরকার এগ্রো ফিসারিজ ও বারানি বায়োটেক ফিস কালচার।