মো. খোরশেদ আলম (জুয়েল): দুঃসময় যেন কিছুতেই পিছু ছাড়ছেনা দেশের মানুষের অন্যতম প্রোটিন যোগানদানের মাধ্যমে পোলট্রি শিল্পের। কখনো নীতি নির্ধারকদের ভুল সিদ্ধান্ত, গবেষকদের ভিত্তিহীন তথ্য, বিভিন্ন মাধ্যমে অপপ্রচার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগবালাই, মুরগি ও ডিমের দামে লাগাতার পতন ইত্যাদি একের পর এক আঘাতে পর্যুদস্ত হতে হতে শিল্পটি এখন বলতে গেলে আইসিইউতে।
বিগত দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্রয়লার মুরগির দাম পাচ্ছেনা খামারিরা। ২০১৮ সনে ছিল ডিমের রেকর্ড পরিমান দরপতন। বিগত বছরে ডিমের দামে কিছুটা স্থিরতা আসলেও ভাগ্য যেন গোস্যা করে আছে ব্রয়লারের দামে। যেহেতু ব্রয়লার মুরগির দাম নেই, বন্ধ হয়ে গেছে হাজার হাজার ফার্ম। খুব স্বাভাবিকভাবেই ব্রয়লারের বাচ্চার প্রতিও খামারিরা আগ্রহ হারিয়েছেন। ফলে একদিন বয়সী বাচ্চার দাম দেড় বছর ধরে কমে গেছে অস্বাভাবিকভাবে। বড় বড় হ্যাচারিগুলো টিকে থাকলেও ছোট ও মাঝারি বহু হ্যাচারি বন্ধ হয়ে গেছে। যারা টিকে আছে প্রতিনিয়ত গুনতে হচ্ছে বহু টাকার লোকসান।
এই যখন অবস্থা চলছিল নতুন করে মরার উপর খরার ঘা হিসেবে দেখা দিয়েছে বিশ্ব মহামারী করোনা ভাইরাস। খামারি পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির দাম গিয়ে ঠেকেছে ৫০ টাকায়, ডিম (সাদা) সাড়ে ৪ টাকায়। সোনালী মুরগির দামও কমেছে ব্যাপক হারে। প্রায় ৩২ টাকা খরচে উৎপাদিত একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চা (ব্রয়লার) ফ্রি দিলেও ডিলার-খামারিরা নিতে চাচ্ছেন না। ফলে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনছেন হ্যাচারি মালিকরা।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এর দেয়া তথ্যমতে, বিগত শুধু ২১ দিনেই পোলট্রি শিল্পে আর্থিক ক্ষতির পরিমান প্রায় ১২শ’ ৭৫ কোটি টাকা! সংগঠনটির দেয়া তথ্যমতে, ওই ক’দিনে বাচ্চা উৎপাদন খাতে ক্ষতি ২৭১ কোটি টাকা, ফিড (খাদ্য) উৎপাদন খাতে ক্ষতি ১১১ কোটি টাকা, ব্রয়লার ও ডিমে ক্ষতি ৮৬৮ কোটি টাকা, প্রক্রিয়াজাতকরণ খাতে ক্ষতি ৫ কোটি এবং ওষুধ খাতে ক্ষতির পরিমান ২০ কোটি টাকা।
দেশের পোলট্রি শিল্পখাতে স্বনামধন্য কোম্পানি নারিশ পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেড এর মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয় এবং বিপণন) সামিউল আলীম এগ্রিনিউজ২৪.কম কে বলেন, চরম একটি সংকটের মধ্যে সময় অতিবাহিত করছি আমরা। ব্রয়লারের বাচ্চার দামে এমনিতেই লোকসানে ছিলাম এতদিন আমরা, বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে ব্রয়লার মুরগির দাম অত্যাধিক কমে যাওয়াতে বিনামূল্যেও কেউ ব্রয়লার বাচ্চা নিতে চাইছেনা। ফলে প্রতি সপ্তাহে হ্যাচিং ডিম নস্ট করে করে ফেলতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। খামার বন্ধ হয়ে যাওয়াতে ফিড বিক্রিও কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাংক প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়াতে লেনদেনের সমস্যা হচ্ছে এবং সেটির প্রভাব পড়ছে মুরগি, বাচ্চা, ও ফিড ক্রয়-বিক্রয় উভয় ক্ষেত্রেই।
সামিউল আলীম বলেন, ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের বাজারের বড় একটি অংশের ক্রেতা হচ্ছে দেশের ছোট-বড় হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ফাস্টফুড শপ ইত্যাদি। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়াতে কমে গেছে চাহিদা, সেই সাথে কমছে ডিম ও ব্রয়লারের দাম। তাছাড়া নেতিবাচক প্রচারনাতো আছেই। সামগ্রিকভাবে অনিশ্চিত সময় অতিবাহিত করছি আমরা।
করোনা পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের বাজারেই মন্দা যাচ্ছেনা, প্রায় বছরখানেক ধরে দেশের মুরগির বাজারে আধিপত্য বিস্তারকারী সোনালী মুরগির বাজারেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। মাত্র কিছুদিন আগেও খামারি পর্যায়ে ১৮০-২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হওয়া সোনালী মুরগি বিক্রি হচ্ছে এখন ১৪০ টাকায়।
এ প্রসঙ্গে ইশ্বরদীর তরুন খামারি শিহাব বিশ্বাস বলেন, সোনালী মুরগির বাজার ভালো দেখে অনেক আশা করে খামারে ৮ হাজার সোনালী মুরগি পালন করেছিলাম। দাম না পাওয়াতে লোকসানের কারণে সেই খামার বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ধার দেনা করে খামারটি করেছিলাম। এখন কী করবো, কীভাবে সেই ধার দেনা পরিশোধ করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা।