বৃহস্পতিবার , ডিসেম্বর ১৯ ২০২৪

পান উৎপাদন ভালো হলেও মূল্য বাজারে ধ্বস

ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : একদিকে টানা বৃষ্টি অন্যদিকে নদ নদীর পানি বৃদ্ধিতে পানের বরজগুলোতে পানি জমতে শুরু করেছে। এ কারণে গাছের গোড়া পঁচে পানপাতা ঝরে পড়ছে। করোনাকালে বাজারে পান নিয়েও দাম পাচ্ছেন না চাষিরা। এ অবস্থায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা। চাষিরা বলছেন, এবার পান চাষে প্রত্যেককেই লোকসানের হিসাব করতে হবে। অথচ এবার পানের উৎপাদন ভালো ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বেচাকেনা সীমিত হওয়ায় প্রথমেই তারা লোকসানের মুখে পড়েন। এখন টানা বৃষ্টিতে তাদের পুরো পান বরজই নষ্ট হতে বসেছে।

পানচাষিরা জানিয়েছেন, পান চাষের জন্য বৃষ্টিপাত ভাল। কিন্তু অতিবৃষ্টি পানের জন্য খুব ক্ষতির কারণ। টানা বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে করোনার কারণেই পানের দাম কমে গেছে। বর্ষা মৌসুমে ৩২ বিড়া (৬৪টি পানে ১ বিড়া) পান বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকায়। অথচ গত বছর বর্ষা মৌসুমে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এবার কম দামেও পান বিক্রি হলেও চাষিদের বরজটি অন্তত থাকছিল। কিন্তু বন্যার পানি ও টানা বৃষ্টিতে সেই বরজই নষ্টের উপক্রম হয়েছে। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের পান চাষিরা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির স্বীকার হচ্ছেন ।

পান উৎপাদনের জন্য উপকুলীয় জেলা বাগেরহাটের যাত্রাপুর-ফকিরহাট এলাকার নাম প্রসিদ্ধ। সুপারি উৎপাদনের পাশাপাশি পান চাষও এই এলাকার মানুষের জন্য আয়ের অন্যতম খাত। কিন্তু এ বছর ভালো নেই পান চাষীরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, টানাবৃষ্টি, জলাবদ্ধতা এবং সবশেষে মুল্য কমে যাওয়ায় কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে পান চাষীদেও মধ্যে।

পান চাষীরা জানান,এক বিঘা জমিতে একটি পানবরজে বছরে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়। বাজার ভালো হলে খরচসহ চার থেকে পাঁচ লাখ টাকায় পান বিক্রি করা যায়। কিন্তু এবার করোনার কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। হটাৎ বন্যার পানি বৃদ্ধি ও অতিরিক্ত বৃষ্টিতে অনেকের পান বরজই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।পানচাষি আব্দুস সালাম জানান, এক বিড়া পান গতবছর এই সময়ে বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকা থেকে ৭০ টাকা দরে। সেই পান এখন বিক্রি হচ্ছে বিড়া প্রতি ১০ টাকা থেকে ১৫ টাকা দরে। আর ছোট যে পান ৫০ টাকা বিড়া দরে বিক্রি হয়েছে, সে পান বিক্রি হচ্ছে বিড়া প্রতি দুই টাকা দরে। পান বিক্রি করে লেবারের খরচটাই উঠছে না। আরেক পানচাষি হাবিবুর বলেন, টানা বৃষ্টির কারণে অনেক পানের বরজ হাঁটু পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে গাছ, আর পচে যাচ্ছে পাতা। পান ভেঙে বাজারে তুললেও নাম মাত্র দামে বিক্রি হচ্ছে। করোনার প্রভাবে রাস্তা ঘাটের দোকানপাটে পান বিক্রি কমে যাওয়ায় কমে গেছে পানের চাহিদা। ধার-দেনা অথবা এনজিও থেকে ঋন নিয়ে অনেকেই কিছু বেশি আয়ের জন্য জন্য পানের বরজ গড়ে তুলেছেন। কিন্তু এ বছর ঋনের টাকা পরিশোধ করা তো দুরের কথা,পরিবারের খাদ্য চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন বর্গাচাষীরা।

এ বছর বাগেরহাট সদরের যাত্রাপুর সহ ফকিরহাট উপজেলায় প্রায় ৫৫০ হেক্টর জমিতে পানচাষ হয়েছে। প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক চাষী পান বরজের সাথে যুক্ত রয়েছে। পানের বরজই তাদের একমাত্র আয়ের উৎস।পুরো পরিবার টাই পান বরজের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল । এই পান চাষের সাথে জড়িত আরো বেশ কয়েক হাজার দিনমজুর মানুষের রুজি-রোজগার।সিডর, আইলা,আম্পানের মত ঝড়, বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন,বন্যা বা অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টির মত নানা প্রতিকুলতার ক্ষয়ক্ষতি সামলে বারবার নতুন স্বপ্নে ঘুরে দাড়িয়েছে তারা। এরই মধ্য উপকূল জুড়ে প্রায় সপ্তাহ ধরে শুরু হয়েছে টানা বৃষ্টি। জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে বাগেরহাটের অনেক অঞ্চল। জমে থাকা পানিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পানের বরজ। চাষীদের কষ্টের উৎপাদনে ভরপুর পানের বরজে এখন শুধুই চাপা কান্না বিরাজ করছে ।পানচাষীরা এখন রীতিমতো হতাশ।নিজেদের হাতে গাড়া পানের বরজই এখন তাদের গলায় কাটার মত বিধেছে।

এ বিষয়ে ফকিরহাট উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোঃ নাছরুল মিল্লাত বলেন,বর্তমানে পানচাষীরা আছেন চতুর্মূখী সংকটে। বেড়িবাঁধ ভাঙ্গন,বন্যায় নদ নদীর পানি বৃদ্ধি ও টানা বৃষ্টিতে পানের বড়জে পানি জমে থাকায় দুশ্চিন্তায় এ অঞ্চলের পান চাষীরা। গেল বছর জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছিল ৩০০ মিলিমিটার। কিন্তু এবার মাস শেষ না হতেই ৪৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এত বৃষ্টি পানবরজের জন্য খারাপ। তাই যেসব পানবরজের আইল কেটে দিলে পানি বের হয়ে যাবে সেসব ক্ষেত্রে তা করার জন্য চাষিদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এ বছর করোনা প্রভাবে দেশের ভেতরে পানের বাজারজাতকরনে বেগ পেতে হচ্ছে চাষীদের। কিছুদিন ধরে বৃষ্টিজনিত কারনে যোগাযোগে বেশ সমস্যা গেছে, দেশের সব বাজারে সময়মত পান পৌছাতে পারেনি।চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশী,আপাতত ব্যাবহার কমে যাওয়া,বাজার ব্যাবস্থাপনায় ঘাটতিসহ নানা কারনে পানের দাম কম। তবে আগামী দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে পানের দাম উর্ধমূখী হতে থাকবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন ।

This post has already been read 3750 times!

Check Also

আমন ধানে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার আক্রমণ: ফলনের ক্ষতি ও করণীয়

ড. মো. মাহফুজ আলম: বাংলাদেশে ধান প্রধান ফসল হিসেবে পরিচিত এবং এর উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির …