বৃহস্পতিবার , ডিসেম্বর ১৯ ২০২৪

নতুন বিশ্বায়নে মানসিক ও সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দ্রুত পরিবর্তনে প্রস্তাবনা

তপন কুমার নাথ : নতুন পরিবর্তিত বিশ্বে নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে এত প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থা আর কোনকালে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেনি। নতুন অর্থ ব্যবস্থা (New Economic Order) কিভাবে পৃথিবীর অর্থ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা ও বিশ্বায়নকে আবার জনকল্যণে পুনর্গঠিত করবে তা সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার পথে। পৃথিবী সৃষ্টির পর বিশ্ববাসী অনেক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও মানবিক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছে কিন্তু নভেল করোনা ভাইরাসের কারণে এতো মৃত্যু পুরো পৃথিবীকে লকডাউনে স্তম্ভিত করে ফেলার মত ঘটনা স্মরণাতীত কালে ঘটেনি। যে প্রাকৃতিক পরিবেশ পৃথিবী বেড়ে উঠেছে পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে ঠিক রয়েছে সেটা এখন প্রলম্বিত অনিশ্চয়তায় যাত্রা করেছে। খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এ নিয়ে আতংক না ছড়াতে সুপারিশ করছে। কিন্তু তারাই ঘোষণা দিচ্ছে নভেল করোনা ভাইরাস এর কারণে কোভিড-১৯ রোগে মৃত্যুর যে মিছিল সেটা প্রতিরোধ করে সুস্থতার কোন চিকিৎসা ব্যবস্থা বা ঔষধ টিকা কিছুরই সম্ভাবনা  অদূর ভবিষতে খুঁজে পায়নি বলে বিবৃতি দিচ্ছে। এতে জনমনে আতংক ছড়িয়ে পড়ছে। এ আতংক না ছড়ানোর জন্য সংস্থাসমূহে মনোবিজ্ঞানী নিয়োগের প্রচেষ্টা নিচ্ছে। বাংলাদেশে এ সংস্থার উপস্থিতি ও প্রচেষ্টা মিডিয়াতে খুব বেশি দৃষ্টিগোচর হয় না। মূলতঃ সদস্য রাষ্ট্রের চাঁদা ও অনুদানে পরিচালিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) নিজস্ব জনবিল এত বড় বা বেশি নয় যেখানে তারা যাবতীয় তথ্য ও গবেষণা সম্বন্বয় করে একটি সমাধান বা পথ নির্দেশনা এ পর্যন্ত তৈরি করতে পেরেছে। তারা সরকারী সংস্থার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রদত্ত তথ্যকেই ব্যবহার করে গবেষণা ও কারিগরী সহয়তায় প্রদানের চেষ্টা করে।

করোনা ভাইরাস থেকে নিজেদের রক্ষা করে হার্ড ইমিউনিটি (Herd Immunity) তৈরি করার সামাজিক সংক্রমণ কমানোর কোন কার্যকর সমাধান আজও অনেক এদেশে দেখা যায় না। এক্ষেত্রে দেশের সরকার, বুদ্ধিজীবী, জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নিজেদের রক্ষার প্রয়াস নেয়া ছাড়া বিকল্প তেমন নেই।

স্বাধীনতার জননেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুণেধরা সমাজ ব্যবস্থা এবং বহুল আলোচিত স্বাস্থ্য ব্যববস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্ধন সূচিত হতে চলেছে। বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য সচিব জনাব আব্দুল মান্নান এর সততা, অনড় ও দৃঢ় মনেবলের কারণে স্বাস্থ্য সংস্থাসমূহের চালক/ পরিচালকের অনিয়ম ও দুর্নীতি উত্থাপিত হতে চলেছে। এটা এমন একটি বার্তা প্রতিটি অধীনস্থ দপ্তর ও সংস্থাসমূহে দেয়া হয়েছে। সবাই সতর্ক বার্তা বহন করে পরিবর্তনের প্রত্যাশায় কিছু সুপারিশ প্রস্তাব করছি।

স্বাস্থ্যনীতি নতুন করে ঢেলে সাজানো যেখানে গণমানুষের হাসিমুখে চিকিৎসা দেবেন সুশিক্ষিত চিকিৎসক সমাজ। মানবিক গুণাবলীকে সবসময় সম্মান দেয়া ও প্রণোদনা দিয়ে উৎসাহ বাড়ানো খুব কঠিন হয় না তবু সেবার সংস্কৃতি তৈরি করাই আবশ্যক। যথাসময়ে পদোন্নতি দায়িত্ব প্রদান করা জাতীয় স্বীকৃতি প্রদান এক্ষেত্রে যাদুকরী পরিবর্তন আনতে পারে।

প্রয়োজনে চিকিৎসক/স্বাস্থ্যকর্মী ও নার্স/প্যারামেডিকদের ব্যবহারিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে বর্তমান পরিস্তিতি মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি রাখা। পৃথিবী সকল দেশেই ফ্রন্ট লাইন ফাইটার্স হিসাবে প্যারামেডিক চিকিৎসক ও মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টদের অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। এখন প্রয়োজন দেশ কয়েক হাজার প্যারামেডিক ও টেকনোলজষ্টিকে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে চিকিৎসকদের কাজে প্রকৃত সহায়তা প্রদানের দ্রুত উদ্যোগ নেয়া। স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ বেকার যুবক- যুবতীদের অনতিবিলম্বে প্যারামেডিক কলেজে বিনা বেতনে প্রয়োজনে বৃত্তি দিয়ে নিয়োগ দেয়া এবং করোনা যুদ্ধে এদের সামিল করার ব্যবস্থা নেয়া।

যেহেতু স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক সুস্থতা বুঝায় তাই দেহকে রোগমুক্ত করার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ের জন্য প্রশিক্ষিত মনোবিজ্ঞানী, মনোচিকিৎসক, কাউন্সেলর, হেলথ সাইকোলজিস্টদের নিয়োগের ব্যবস্থা উন্নত করা উচিত। শহর ছেড়ে লক্ষ যুবক-যুবতী বেকার এখন গ্রামমুখী আবার প্রাকৃতিক বন্যা বিতাড়িত নদীভাঙ্গা মানুষ ভাত ও ভিক্ষার জন্য শহরমুখী, এতে সমাজের কাঠামো বিবর্তন ঘটছে। দেশের মানুষে উন্নয়নের জন্য কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে শহরে ও গ্রামে। কৃষি অর্থনীতি আরও কয়েক দশক আমাদের দেশে খাদ্য পুষ্টি সংস্থানের অবদান রাখবে। তাই গ্রামে ফিরে যাওয়া বেকার মানুষকে কোভিড-১৯-এর প্রণোদনা দিয়ে গ্রামেই নিয়োজিত করে রাখতে হবে। এরা নিজ বাড়ির বৈঠখানায়, বারান্দা বা সামনের দেয়াল খুলে তরিতরকারী, মুদির দোকান, মোবাইল ফ্লেক্সিলোডের ক্ষুদ্র ব্যবসা করতে পারে।

সর্বোপরি S.S.C/H.S.C পাস যুবক-যুবতীদের ১ থেকে ৩ বছর মেয়াদী কমিউনিটি প্যারামেডিক শিক্ষায় ও ডিপ্লোমা দিয়ে গ্রামের দুঃখী মানুষের চিকিৎসায় সেবায় প্রাথমিক স্তরে নিযোগ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এরা গ্রামাঞ্চালে প্রতিষ্ঠিত কমিউনিটি ক্লিনিকে রোগীর বাড়তি চাপ সামলানোর কাজে সহায়তা করতে পারে। গোড়দোরায় সহজ স্বাস্থ্য সেবা পেলে এরা শহরমুখী কম হবে। কমিউনিটি ক্লিনিকে বিকল্প চিকিৎসক ব্যবস্থা যেমনঃ হোমিওপ্যাথী, আর্য়ুবেদিক, খাদ্য ও পুষ্টি জ্ঞান, ব্যায়াম ও সঠিক জীবন পদ্ধতি জনগণ পছন্দমত বেছে নিতে পারে। এতে শিশু ও মাতৃমৃত্যু যেমন কমবে, তেমনি প্রবীণরাও ঘরের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসার সেবা পাবে। প্রয়োজনে তাদের নিকটবর্তী উপজেলা / জেলা হাসপাতালে কমিউনিটি চিকিৎসক থেকে সেকেন্ডারী রেকারেস করে পাঠিয়ে দিতে পারে। কোনভাবে রোগীদের সাথে অসম্মানজনক কড়া দুর্ব্যবহার করা যাবে না। কর্তৃপক্ষ এটা নিশ্চিত করবেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) পৃথিবী জুড়ে বিগত ২ দশক আগে স্বাস্থ্যকর নগর কার্যক্রম (Health City Program) চালু করেছিল। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এই মডেল প্রথম চালু হয় চট্টগ্রামে তৎকালীন মেয়র জনাব মহিউদ্দিন চৌধুরীর  নেতৃত্বে। এ মডেল পৃথিবীর বিভিন্ন শহরের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্তে পরিণত হয়। এখানে ভারত-নেপালের নগর পরিকল্পনাবিদ নগর পরিদর্শন ও শিক্ষাগ্রহণের জন্য (WHO) প্রায় অর্থায়নে প্রতিবছর শিক্ষা সফরে আসতেন। জামালখান হেলদি ওয়ার্ড ও ১টি মডেলে সবুজ বনায়নে নজর কাড়তে সক্ষম হয়। এক্ষেত্রে নির্বাচিত মেয়র, জনপ্রতিনিধি, কাউন্সিলর, প্রশাসক ও বেসরকারী সংস্থা এবং মিডিয়াদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে প্রতিমাসে মতবিনিময় করতেন এবং প্রয়োজনীয় পরিবর্তন স্থানীয় সম্পদের মাধ্যমে গঠিত করতেন। (WHO) প্রয়োজনে কারিগরী সহায়তা (Technical Assistance) প্রদান করতে দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণসহ পরে WHO এ মডেলকে Health School/ Health Village/Health Hospital/Health Settings এ বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেন। ২০২০ মাসিক বিশ্বায়ন ও মুক্তাকাশের মে ২০২০ ১ম সংখ্যা এ লেখকের একটি লেখা ‘স্বাস্থ্যকর নগর পরিকল্পনা’ নামে প্রকাশিত হয় যা স্বাস্থকর পরিবেশ তৈরির ধাপসমূহ বর্ণনা করা হয়েছে। কোভিড-১৯ প্রতিকারের এ মডেলকে আবার সক্রিয় করা যায়। এতে মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে জীবন রক্ষায় সচেষ্ট হবে।

আমাদের নেতৃত্ব একটি সমন্বিত এবং সবাইকে একত্রিত করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা, সুস্থ ও উন্নয়ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বর্তমান মহামারীতে লকডাউনে তরুণ, যুবক, প্রৌঢ় ও প্রবীণরা শারীরিক, সামাজিক, মানসিক সমস্যার চরম ভোগান্তিতে রয়েছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্দী শিশু, প্রবীণদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণে জোড়ালো পদক্ষেপ এখন সমযের দাবী। বেগম সায়মা ওয়াজেদের নেতৃত্বে শিক্ষা মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগ ও নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল ডিজএবিলিটি ট্রাস্টের মাধ্যমে অটিজম-সংশ্লিষ্ট সেবা প্রয়োগ করা ও শিক্ষকদের সেবায় সে কর্মপরিকল্পনা ও জনসচেতনায় তৈরি হয়েছিল তা বর্তমান কোভিডের সময়ে স্থিমিত হয়ে পড়েছে। এদের সেবায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্পনা মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীদের নিয়োগদানে দ্রুত উদ্যোগ নিয়ে সেবা প্রদান জরুরি। আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণে সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক: বিসিএস, প্রাক্তন প্রকল্প কর্মকর্তা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), ঢাকা।

This post has already been read 4486 times!

Check Also

ডিম ও মুরগির বাজার স্থিতিশীলতায় দরকার  “জাতীয় পোল্ট্রি বোর্ড” গঠন

কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার : পোল্ট্রি শিল্পের সাথে আন্ত:মন্ত্রনালয়, আন্ত:অধিদপ্তর  এবং উৎপাদন ও বিপননে ডজনের উপরে …