কৃষিবিদ এম. আব্দুল মোমিন : কৃষিকে মানব সভ্যতার জাগরণ শুরু। বলা হয়ে থাকে কৃষিই কৃষ্টির মূল। কেননা কৃষি বাংলাদেশের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে আছে। বাংলাদেশ ধানের দেশ-গানের দেশ-পাখির দেশ। তাই অগ্রহায়ণে ধান কাটার উৎসব গ্রামবাংলা তথা বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্য। পহেলা অগ্রহায়ণ মানেই ছিল বাঙালি গেরস্থ বাড়িতে উৎসবের আমেজ। নতুন ধানের গন্ধে ম ম উঠান বাড়ি। আবহমান এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পহেলা অগ্রহায়ণ দিনটি নবান্ন উৎসব হিসেবে পালন করে আসছে এদেশের কৃষিতান্ত্রিক পরিবারগুলো। ২০০৮ সালে তৎকালীন সরকার এই দিবসটিকে প্রথমবারের মতো জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার পেছনে ছোট্ট একটা গল্প আছে। ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে হঠাৎ চালের সরবরাহ কমে যায়। চালের মূল্য বেড়ে যাওয়ার এ সময় বাংলাদেশ অর্থ দিয়েও চাল কিনতে পারেনি। প্রতিবেশী দেশ ভারত চাল রপ্তানির আশ^াস দিয়েও পরে টালবাহানা শুরু করে তখন তৎকালীন সরকারের বোধোদয় হয়। তাঁরা বুঝতে পারে জাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কৃষিতে গুরুত্ব দেয়ার বিকল্প নেই। যে কথা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই।
এমনই এক প্রেক্ষাপটে ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, “দুনিয়া ভরে চেষ্টা করেও আমি চাল কিনতে পারছি না। চাল পাওয়া যায় না। যদি চাল খেতে হয় আপনাদের চাল পয়দা করে খেতে হবে।” মাছে-ভাতে বাঙালীর সেই ভাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিতে গুরুত্বারোপ ও উৎপাদন বৃদ্ধির বিকল্প নেই বুঝতে পেরে ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পহেলা অগ্রহায়ণ জাতীয় কৃষি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। ওই বছর সারাদেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারিভাবে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হয়। তারপর ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পহেলা অগ্রহায়ণ পালিত হয় জাতীয় কৃষি দিবস। দেশে পালিত অন্য অনেক দিবসের মধ্যে জাতীয় কৃষি দিবস বা নবান্ন উৎসব এমন একটি আয়োজন যাতে দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের সম্পৃক্ততা রয়েছে।
নবান্ন ঋতুকেন্দ্রিক একটি উৎসব। শাব্দিক অর্থের দিকে বলতে পারি, ‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়। এই উৎসব পালিত হয় অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম দিন। অগ্র অর্থ ‘প্রথম’। আর ‘হায়ণ’ অর্থ ‘মাস’। এ থেকে সহজেই ধারণা করা হয়, একসময় অগ্রহায়ণ মাসই ছিল বাংলা বছরের প্রথম মাস। হাজার বছরের পুরোনো এই উৎসব সবচেয়ে অসাম্প্রদায়িক, সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী এবং সবচেয়ে প্রাচীনতম মাটির সঙ্গে চিরবন্ধনযুক্ত।
বাংলাদেশ অগ্রহায়ণ মাসের প্রথমদিন নবান্ন উৎসব পালন করা হলেও কৃষিভিত্তিক সভ্যতা প্রধান শস্য সংগ্রহকে কেন্দ্র করে যেকোনো ঋতুতে এ উৎসব পালিত হয়ে থাকে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের ওয়াজিরাবাদে নবান্ন উৎসব পালিত হয় বৈশাখ মাসে। সেখানে রবিশস্য গম ঘরে তোলার আনন্দে এ বৈশাখী নবান্ন উৎসব পালন করা হয়। দক্ষিণ ভারতেও প্রচলিত আছে এমনি ধরনের নবান্ন উৎসব। বাংলাদেশের কয়েকটি উপজাতিও তাদের প্রধান ফসল ঘরে তোলার পর নবান্ন উৎসব পালন করে। সাঁওতালরা পৌষ-মাঘ মাসে শীতকালীন প্রধান ফসল ঘরে তুলে উদ্যাপন করে সোহরায় উৎসব। জুম চাষি ম্রো উপজাতি চামোইনাত উৎসবে মুরগি বলি দিয়ে নতুন ধানের ভাতে সবাইকে ভূরিভোজন করায়। ফসল তোলার পর গারো উপজাতি ফল ও ফসলের প্রাচুর্যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে পালন করে পানাহার ও নৃত্যগীতবহুল ওয়ানগালা উৎসব (সূত্র: বাংলাপিডিয়া)।
বাংলার মুসলিম কৃষক সমাজ অগ্রহায়ণের প্রথম শুক্রবার থেকে নবান্ন উৎসব শুরু করে। সনাতন হিন্দু সম্প্রদায়ের কৃষকরা তাদের পঞ্জিকা অনুসারে ১ অগ্রহায়ণ থেকে নবান্ন উৎসব পালন করে থাকে। বাংলাদেশের পাহাড়ি জনপদেও চলে নতুন ধানের নবান্ন উৎসব। পৃথিবীর বহু দেশে অনেক আগে থেকেই জাতীয়ভাবে কৃষক দিবস পালিত হয়ে আসছে, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রদেশে নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে কৃষি দিবস পালনের রেওয়াজ আছে। আইওয়াতে ২০০৫ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ থেকে ১২ জুলাই তিনদিনব্যাপী কৃষি দিবস পালিত হয়ে আসছে। উত্তর ক্যারেলিনায় ৩১ জুলাই থেকে ২ আগষ্ট তিনদিনব্যাপী ১১ পর্বে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কিমব্যালে ২৭ সেপ্টেম্বর ১৩ পর্বে উদযাপিত হয় কৃষি দিবস। আফগানিস্তানে ইংরেজি ২০ মার্চ নওরোজ উদযাপনের দিন পালিত হয় কৃষি উৎসব। স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় যাসনি দেহকান বা কৃষকের উৎসব।
গল্প কবিতায় নবান্ন এসেছে অন্যভাবে। কবি জীবনান্দ তার কবিতায় লিখেছেন- ‘অশ্বত্থ পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে/ শুকনো মিয়ানো ছেঁড়া, অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে/ সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে/ হেমন্ত এসেছে তবু;’ (অঘ্রান প্রান্তর, বনলতা সেন)। অগ্রহায়ণ মানেই ‘আমন’ ধান কাটার মাস। ‘ বাংলার শস্যহীন প্রান্তরে’ যখন ‘গভীর অঘ্রান’ এসে দাঁড়ায়, তখন উসবের রঙ ছড়িয়ে পড়ে বাংলার আকাশ-অন্তরীক্ষে। ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিনগুলি বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে। কিষাণ-কিষাণীর প্রাণমন ভরে ওঠে এক অলৌকিক আনন্দে। অর্থাৎ জাতীয় কৃষি দিবসের প্রধান আর্কষণ নতুন ধান কাটার উৎসব বা নবান্ন। সোনালি ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালি সংস্কৃতির বিশেষ অংশ প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় বারবার ধরা পড়েছে দারুণভাবে। তিনি লিখেছেন, ‘চারিদিকে নুয়ে পড়ে ফলেছে ফসল/ তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল/ প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে-থেকে আসিতেছে ভেসে/ পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাড়ারের দেশে।’ পুনর্বার ফিরে আসার আকুতি ধ্বনিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের আরেকটি কবিতায়, ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয় হয়তো শঙ্খচিল শালিখের বেশে;/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’। নবান্নে প্রকৃতির বিচিত্র রূপের বর্ণনা দিয়েছেন এ দেশের কবি-সাহিত্যিকরা। নবান্নের বর্ণনা দিয়ে কবি আবু জাফর লিখেছেন-সবুজ ঘাসে শিশির হাসে, মুক্তার সাজে/মৌমাছি গায়ছে গান, গুনগুন সুর বাজে। সোনালী ধান নবান্ন ঘ্রাণ ভরে যায় মন/কৃষকের মন-প্রাণ, ধন-ধান্যে পরিপূরণ।
কৃষক-কৃষাণীরা নবান্নের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নবান্নে বাড়ির জামাইকে নিমন্ত্রণ করা হয়। মেয়েকেও বাপের বাড়িতে ‘নাইয়র’ আনা হয়। নবান্ন আর পিঠেপুলির উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। তাই অগ্রহায়ণ এলেই সর্বত্র ধ্বনিত হয়, ‘আজ নতুন ধানে হবে রে নবান্ন সবার ঘরে ঘরে।’ কুয়াশায় আচ্ছন্ন চারদিক আর কৃষকের গোলায় উঠছে পাকা ধান। চিরায়ত বাংলার চিরচেনা রূপ এটি। কৃষকের মাঠে তখন সোনারঙা ধানের ছড়াছড়ি। কৃষক রাশি রাশি সোনার ধান কেটে নিয়ে আসে ঘরে। ধান ভাঙার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে, ঢেঁকির তালে মুখর হয় বাড়ির আঙিনা। নতুন চালের ভাত আর নানা ব্যঞ্জনে সৃষ্টি হয় আনন্দঘন পরিবেশে। তৈরি হয় নতুন চালের পিঠা, ক্ষীর-পায়েস। মুসলিম সমাজে মসজিদে শিন্নি দেওয়ার রেওয়াজও আছে, সনাতন সমাজের কৃষকের ঘরে ঘরে চলে পূজার আয়োজন।
নবান্ন উৎসব হলো বাঙালি জাতির ঐতিহ্য, যা বাঙালিকে জাগ্রত করে তোলো। নবান্ন উপলক্ষে জাতীয়ভাবে জেলা-উপজেলায় কৃষি মেলার আয়োজন করা হয়। কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত শ্রেষ্ঠ কৃষকদের জেলা ও উপজেলা কৃষি বিভাগ বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করে কৃষি কাজে আরও আগ্রহ বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। দেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ও কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বর্ণাঢ্য র্যালি, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে জাতীয় কৃষি দিবস।
নগরও নবান্ন উৎসব উদযাপনে পিছিয়ে নেই আর। ‘এসো মিলি সবে নবান্নের উৎসবে’ এই শ্লোগান সামনে রেখে প্রতিবছর নগরে নবান্ন উৎসব পালিত হয়েছে। এই সময়ে কৃষকের ঘরে নতুন ফসল আসে, সোনালি ফসলে ভরে ওঠে কৃষকের গোলা। ঘরে থাকে খুশির আমেজ, আর সেই খুশির বহিঃপ্রকাশ ঘটে নবান্ন উৎসবের মাধ্যমে। রাজধানীর শাহবাগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে ও বকুলতলায় প্রতিবছর নবান্ন উৎসব উদ্যাপিত হয়। উৎসবে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, বাউলগান, আদিবাসীদের পরিবেশনা ও নবান্নকথন সহ ঐতিহ্যবাহী নানা রকম পিঠা প্রদর্শনী করা হয়ে থাকে। বলতে গেলে অগ্রহায়ণের প্রথম সকালে নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে রাজধানীবাসী। নানা শিল্পীদের কণ্ঠে আনন্দে মাতিয়ে তুলে রমনা বটমূল কিংবা চারুকলা প্রাঙ্গন।
নবান্ন উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হলো নবান্নের প্রাণ গ্রামীণ মেলা। হরেক রকমের দোকান নিয়ে বসে গ্রামীণ মেলায়। এই মেলায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের পিঠা-ফুলি, মিষ্টি-সন্দেশ, মন্ডা-মিঠাই, খেলনা-পুতুল, মাটির তৈজষপত্র। আর বাড়তি আনন্দ দিতে বসে বাউল গানের আসর। নবান্ন উৎসবকে ঘিরে নাচে-গানে মুখরিত থাকে মেলাপ্রাঙ্গণ। প্রকৃতি আর পরিবেশের মধ্যে আত্মহারা হয়ে ওঠে বাঙালি মানষ।
পরিশেষে একটি বিষয় না বললেই নয়। সেটি হলো- নবান্নের ফসল আমন কাটা ও ঘরে তোলার আনন্দ করলেই হবে ধান সংরক্ষণের উপায়ও। ঠিক মতো আমন সংরক্ষণ করা না গেলে কৃষক পরিবারের নবান্নের আনন্দ ফিকে হয়ে যেতে পারে। আমনের মাঠে শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে ফসল কেটে মাঠে বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হবে। দ্রুত ও লাভজনক মাড়াইয়ের কৌশল হিসেবে ব্রি উদ্ভাবিত মাড়াই যন্ত্র যেমন- রিপার, হেড ফিড কম্ভাইন হার্ভেস্টার ও মিনি কম্ভাইন হার্ভেস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। ধান মাড়াই করার জন্য অবশ্যই পরিচ্ছন্ন জায়গা বেছে নিতে হবে। কাঁচা খলায় সরাসরি ধান মাড়াই করার সময় চাটাই, চট বা পলিথিন বিছিয়ে নেয়া উচিত। এভাবে ধান মাড়াই করলে ধানের রঙ উজ্জ্বল ও পরিষ্কার থাকে। মাড়াই করার পর অন্তত ৪-৫ বার রোদে ভালোভাবে শুকানোর পর ঝেড়ে নিয়ে গোলাজাত বা সংরক্ষণ করতে হবে।
উপসংহার টানবো আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের কৃষকের স্বার্থরক্ষার একটি আকুতির কথা উল্লেখ করে। তিনি মেহনতি মানুষের স্বার্থরক্ষায় সমস্যা জর্জরিত কৃষকের পক্ষে যে দাবিগুলো পেশ করেছিলেন, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য রয়েছে। কৃষক যাতে তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য ও উপযুক্ত মুনাফা পায়, নিজের জমিতে যেন তার কায়েমি স্বত্ব বজায় থাকে এবং কৃষি-জমি থেকে তাকে যেন উচ্ছেদ করা না হয় – এ দাবিগুলো জাতীয় কবি নজরুলের। আজকের দিনেও শুধু কৃষক নয়, গোটা জাতির কাছে দাবিগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় কৃষি দিবস বাঙালি জনজীবনে অনাবিল আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক। সকল ক্ষেত্রে এদেশের খেটে খাওয়া কৃষকের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হোক এই কামনায় শেষ করছি।
লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর-১৭০১।