নাহিনূর রহমান: আমরা খামারীরা প্রায়শই একটা কমন প্রশ্ন করি তা হলো এই গাভীটা কেমন? বা অনেকে বলি যে বিশ লিটারের বেশী দুধ দেয়া গাভী কোথায় পাবো?
বন্ধুরা আসুন একটা সহজ হিসেব করি। ধরুন, আপনি বিয়ে করতে চাইছেন আমাদের সমাজের প্রচলিত নিয়ম হলো আমরা আগে পাত্র/ পাত্রীর খোঁজ করি, তার বংশ পরিচয়, মামা চাচা খালা ফুফুদের খোঁজ করি তারপর দেখি দেখতে কেমন, শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠিত কেমন তা দেখি, তারপর আসি সৌন্দর্য ও সৌষ্ঠবের দিকে, সোজা কথা আমরা ইতিহাস জানতে চাই। এগুলো আমরা কেন করি, যেন ভবিষ্যতের জীবনটা সুন্দর হয়।
কেউ জেনে বুঝে তার আদরের সন্তানকে বিতর্কিত সম্পর্কে জড়াতে দেবেনা, আবার অনেকে বিতর্ক থাকলে সেটা গোপনে চেপে যেতে চান সযতনে।
এই গুণাগুণ ও বাছ বিচার কিন্ত চলতে থাকে পরবর্তী সময়েও। এমন কি কিছু গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ চলে দুইপক্ষের অজান্তেই।
জেনে বোঝে নিশ্চয়ই আমরা উপরের শর্তগুলোর একদম বাইরে গিয়ে কোন সম্পর্ক করতে চাইবোনা, কিংবা সবার ছবি দেখেই সম্পর্কের পরিপূর্ণতা টানতে মনস্হির করবোনা।
বন্ধুরা এই একই নিয়ম প্রযোজ্য আপনি ডেইরী খামারী হতে চাইলে। আপনি হঠাত একটা ছবি আর ঘটকের কথা বিশ্বাস করে গরু আনলে সবসময় নাও জিততে পারেন ঠকার সম্ভবনা বেশী।
গরু কিনতে হলে আপনাকে জানতে হবে :
■ গরুর এনাটমি বা শরীর তত্ব;
■ তার বাবা মা নানী দাদীর ইতিহাস;
■ তার যৌবন ও যৌনজীবনের ইতিহাস;
■ তার প্রেম ভালবাসা আর পছন্দের কথা;
■ জানতে হবে সে বিকালে কতটুকু আর সকালে কতটুকু দুধ দেয়। ☆☆আগে বিকাল পরে সকাল☆☆
■ তাকে জোরপূর্বককোন কাজে বাধ্য করা হচ্ছে কিনা, গরুর চোখের ভাষা আর দেহের আবেদন বুঝতে হবে।
এবার আসেন সে কি খায়, কি চায়?
আপনাকে মনে রাখতে হবে গরুর দুধ দোহন ও তার বাচ্চা উৎপাদন পুরো প্রক্রিয়ার সাথে অনেক কিছু জড়িত। গরু প্রতিবার দুধ দেবার সময় অনেক কিছু শরীর থেকে ছেড়ে দেয়, আপনি এগুলো পূরণ না করলে বিপদ হবেই হবে।
প্রথমে আসেন পরিচ্ছন্নতা ও হাইজিন
■ আমরা বলি দুধ দোহনের আগে হাইজিন মাস্ট আর দোহনের পর ডিকন্টামিনেশন ফার্স্ট।
অর্থাৎ আপনি দুধ দোহনের পূর্বে দোহনকারী ও দুধ প্রদানকারী উভয়ের ই পরিচ্ছন্ন হতে হবে, হাত সাবান দিয়ে ধুবেন আর আডার ঠান্ডা পরিস্কার জলে মুছবেন।
■ গরুর দুধ দেবার সিগন্যাল টা আসে তার হাইপোথ্যালামাসের অক্সিটোসিন রিলিজ হবার মাধ্যমে; এই ঘটনার স্হায়িত্ব সাড়ে চার থেকে পাচ মিনিট ।অতএব প্রেম ভালবাসা করার এই পাচ মিনিটেই করতে হবে এবং শুরু করবেন পেছনের বাট থেকে।
■ জোর করে যেমন ভালবাসা হয়না বেশী জোরকরলে হয় সেটা নির্যাতন আর এরবেশী গেলে ধর্ষণ তেমনি দুগ্ধ দোহনের সময় জেরবার চলবেনা, তাহলে ফেসে যাবেন।
■ দোহন শেষে টিটস এর মুখ প্রায় তিনগুন প্রসারিত হয়ে থাকে তাই এটিকে জীবাণুমুক্ত রাখা অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ এবং এটা আপনার ম্যাসটাইটিসের ঝুকি হ্রাস করবে 70%। তাই দোহন শেষে ডিকন্টামিনেশন মাস্ট।
■যেকোন ভালবাসাই পরিশ্রম সাধ্য কাজ।তাই গরুকে দোহন শেষে দানাদার খেতে দিন, এটি আপনার গরুর ম্যাসটাইটিসের ঝুকি কমাবে আরো বিশ ভাগ।
এবার আসুন মিনারেল ও ভিটামিন। কিশোরী মেয়ে অল্প বয়সে বিয়ে হলে যেমন অকাল মাতৃত্বে হারায় তার রুপ আর শক্তি, যৌবনের ভরাট গাঙ হয়ে যায় মরানদী তেমনি আপনার অযত্নে আপনার প্রিয় গাভীও একসময় হয়ে যাবে ড্রাই।
■ গরুর ক্যালসিয়াম লেভেল কখনো ডাউন হতে পারবে না;
■ সোমাটিক সেল বেশী হতে পারবে না;
■ ফসফরাসের ঘাটতি হতে পারবে না;
■ মাইক্রো মিনারেল যেমন কপার, জিংক ,আয়োডিন কোবাল্ট, মলিবডেটের, অভাব হওয়া চলবে না;
■ ল্যাকটেশন সাইকেল ৩০৫দিনের বেশী যাওয়া যাবে না;
■ জরায়ুর স্বাস্থ্য দূর্বল হলে চলবেনা;
■পানি ও লবণের ঘাটতি হতে পারবেনা ।
এবার আসুন পথ্য আর বীজের কাছে
■ পথ্যের প্রথম হবে কৃমি মুক্ত করণ আর পরজীবী মক্ত করণ হোক সেটা ভিতর বাহির যেখানেই।
■ প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক মাইক্রোগ্রাম ভ্যাকসিন ও এন্টিবায়োটিক নয়।
■ আপনি বুদ্ধিমান প্রাণী তাই গরুর মত অবলা প্রাণীকে না বুঝে বেকুবের মত একটু হরমোন ও দেবেন না।
■ বীজ যদি কৃত্রিম ভাবে দেন তাহলে তো এমনিতেই গরুর যৌবনের উপর একটি অযাচিত হস্তক্ষেপ করছেন সেখানে ভাল বীজটাই দিন, ভালো মানেই কিন্ত 100% না, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে 75%-87%বেস্ট, শুধু খেয়াল করবেন ইনব্রীড যেন না হয়, যেন সন্তানের মুখ দেখে গরু শান্তি পায়।
■ বাছুর জন্মের আধা ঘন্টার মাঝে যেন শাল দুধ পায় এবং প্রথম একমাস সে দুধে পেট ভরে রাখবে। এটাই হবে আপনার ভবিষত বিনিয়োগ।
এসব কিছু যদি মিলিয়ে রাখতে পারেন তবে আপনি হাই ইয়েল্ড গাভী দিয়ে শুরু করুন; আর যদি ভাবেন এত পরিশ্রম আপনার সইবে না তাহলে ডেইরী আপনার জন্য না।
লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ঐতিহ্য এগ্রো ফুড।