বৃহস্পতিবার , নভেম্বর ২১ ২০২৪

বোরো আবাদে যে সকল কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনাসমূহ অনুসরণ করতে হবে

ড. মো.শাহজাহান কবীর :বোরো আবাদে যে সকল কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনাসমূহ অনুসরণ করতে হবে সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো-

আদর্শ বীজতলায় চারা তৈরি

অনেক সময় কৃষকরা আদর্শ বীজতলায় চারা করতে চায় না। অনুর্বর জমিতে এবং গাছের ছায়ায় বীজতলা করেন কৃষকরা এবং ফলে চারার গুণগত মান  খারাপ হয় এবং পরবর্তীতে  ঐ চারা হতে কাঙ্ক্ষিত ফলন পাওয়া যায় না। আদর্শ বীজতলা হতে সুস্থ সবল চারা হবে এবং কাঙ্খিত ফলন পাওয়া যাবে এবং বীজের সঠিক হার বজায় থাকে এবং বীজ সাশ্রয় হয়।

বেশি বয়সী চারার ব্যবহার

কৃষকরা নানান কারণে (সময়মতো সেচের পানি না পাওয়ায়) বেশি বয়সের চারা মাঠে রোপণ করে, ফলে বেশি বয়সের চারা হতে বেশি কুশি হয় না এবং পরবর্তীতে ফলন কমে যায়। বোরো মওসুমে অবশ্যই ৩৫-৪৫ দিন বয়সের চারা রোপণ  করতে হবে। সঠিক বয়সের চারা রোপণ করলে সর্বোচ্চ কুশির সংখ্যা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে কাঙ্খিত ফলন পাওয়া সম্ভব। সাধারণত ১৫ ডিসেম্বর হতে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। এর পরে রোপণ করলে প্রতি দিনের জন্য ফলন কম হবে।

সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ

অনেক এলাকার কৃষকরা সুষম মাত্রায় সঠিক সার, যথা- ডিএপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক ব্যবহার করে না। কিন্তু গাছের বাড়-বাড়তির এবং পর্যাপ্ত কুশি উৎপাদনের জন্য সুষম সার প্রয়োগ করা খুবই জরুরি। কৃষকদের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের সহায়তায় জমির উর্বরতা বিবেচনা করে সুষম সার প্রয়োগ করতে হবে।

ইউরিয়া সার ব্যবহারে সতর্কতা

কৃষকরা চারা লাগানোর ৭-১০ দিনের ভিতর একবার এবং ফুল আসার আগে আরেকবার উপরি প্রয়োগ করেন। কিন্তু কুশি আসা ও কুশি উৎপাদনের সময় সার প্রয়োগ করে না। ফলে কুশির সংখ্যা কমে গিয়ে ফলন কমে যায়। আবার অনেক সময় কাইচ থোড় আসার ৫-১০ দিন পূর্বে যে ইউরিয়া সার দিতে হয় তা না জানার জন্য সঠিক সময়ে প্রয়োগ করে না। ঐ সময়ে সার দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঐ সময় ইউরিয়া সার দিতে না পারলে ধানের ছড়ায় দানার সংখ্যা কমে যায় এবং ফলন কম হয়। সঠিক সময়ে ইউরিয়া/নাইট্রোজেন সার দেওয়ার ব্যাপারে কৃষকদের সচেতন করে তোলার জন্য উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের ভূমিকা রাখতে হবে। ক্রান্তিকাল (Critical  Period) সময়ে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে।

সঠিক সময়ে আগাছা দমন

আগাছা সঠিক সময়ে দমন না করলে বোরো মওসুমে প্রায় ৩০-৪০ ভাগ পর্যন্ত ফলন কমে যায়। বোরো মওসুমে চারা লাগানোর পর দুইবার/তিনবার আগাছা পরিস্কার করতে হয় বা সঠিক আগাছানাশক প্রয়োগ করে আগাছা দমন করা যায়। বোরো মওসুমে আগাছা দমনের ক্রান্তি কাল (Critical time) হল ৪৫-৫০ দিন। ঐ সময় পর্যন্ত ধানক্ষেত আগাছামুক্ত রাখতে পারলে ফসলের ক্ষতি হবে না। কিন্তু অনেক সময় কৃষকরা সঠিক সময়ে আগাছা দমন না করায় আগাছা ধান গাছের সাথে খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতা করে ধানের ফলন কমিয়ে দেয়। বোরো মওসুমে চারা লাগানোর অন্তত ৪৫ দিন পর্যন্ত আগাছামুক্ত রাখতে হবে।

জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো

জমিতে জৈব সার তথা ধইঞ্চা বা গোবর সার বা ফার্ম ইয়ার্ড সার ব্যবহার করলে অন্যান্য অজৈব সার যেমন- ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম ও জিংক সারের কার্যকারিতা বাড়ে; জমির পানিধারণ ক্ষমতাও বাড়ে। জমির ভৌত, জৈবিক ও রাসায়নিক পরিবর্তন এর ফলে পরবর্তীতে ফলন বাড়ে। কিন্তু  কৃষকরা প্রায়শই জৈব সারের ব্যবহার করে না। সাধারণত রোপা আমন ধান কাটার পর জমি ১৫-৩০ দিন পতিত থাকে; এসময় ধৈইঞ্চা বা অন্যান্য জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে। তাছাড়া ধান কাটার সময় ২০ সেমি. উচ্চতায় খড় জমিতে রেখে পরবর্তী ফসল চাষের আগে মাটিতে মিশিয়ে দিলে ক্রমান্বয়ে জমিতে জৈব সার ও পটাশের পরিমাণ বড়ে।

স্থানভিত্তিক সঠিক জাতের বীজের প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণ ও এগুলোর চাষাবাদ বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানভিত্তিক উপযোগী কৃষিতাত্ত্বিক ব্যবস্থাপনা অনুসরণ, মানসম্মত সুস্থ ও সবল বীজের ব্যবহার, সঠিক সময়ে বীজ বপন, সঠিক পদ্ধতিতে বীজতলা ও জমি তৈরি, সঠিক বয়সের চারা সঠিক সময়ে রোপণ, সঠিক দূরত্বে রোপণ, সঠিক পদ্ধতিতে ও সঠিক মাত্রায় সার প্রয়োগ, গাছের চাহিদা ভিত্তিক ইউরিয়া সারের প্রয়োগ, ধান গাছ বৃদ্ধির সঠিক সময়ে ইউরিয়া ও পটাশ সারের উপরি প্রয়োগ, রোপণের ৪৫ দিন পর্যন্ত জমি আগাছা মুক্ত রাখা, সঠিক পানি ব্যবস্থাপনা, উপযুক্ত সময়ে ধান কর্তন, সঠিক পদ্ধতিতে প্রাক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ করা গেলে বোরো ফলন বাড়াতে সরকার গৃহীত পদক্ষেপগুলো ফলপ্রসু হবে।

সেচজনিত প্রতিবন্ধকতা প্রতিকারসমূহ

দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পাবনা, বগুড়া, নাটোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় সেচ কাজ বিঘ্ন হচ্ছে। হাওর এলাকার এপ্রিল-মে মাসে কিছু স্থানে ভূপরিস্থ (ছোট নদী, খাড়ি, নালা ইত্যাদি) পানির অভাবে বোরো ফসলের শেষ পর্যায়ে সেচ প্রদানে সম্ভব না হওয়ায় প্রায়শই ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হয়। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ত পানির জন্য এবং উপকূলীয় অলবনাক্ত এলাকায় সেচ অবকাঠামোর অভাবে বোরো চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। বরেন্দ্র এলাকায় সেচ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং পানি সাশ্রয়ী শস্যবিন্যাস প্রচলন করতে হবে। স্বল্প ডিসচার্জের গভীর নলকূপের ব্যবহার করা যেতে পারে। হাওর এলাকায় বিদ্যমান ছোট নদী, খাড়ি, নালাসমূহ পুনঃখনন করে ভূপরিস্থ পানির মজুদ বৃদ্ধিকরণ। ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারের সুযোগ থাকলে তা দিয়ে সম্পূরক সেচ প্রদান করে বোরো উৎপাদন সুনিশ্চিত করা যেতে পারে। উপকূলীয় এলাকায় সরকারি পর্যায়ে সেচ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সেচ অবকাঠামো উন্নয়ন করা প্রয়োজন।

অঞ্চলভিত্তিক প্রতিবন্ধকতাসমূহ প্রতিকার

হাওর অঞ্চল

হাওর এলাকায় সঠিক জাত নির্বাচন একটি সমস্যা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঐ এলাকায় যদি আগাম পানির ঢল আসে সেক্ষেত্রে  দীর্ঘ জীবনকাল জাত যেমন ব্রি ধান২৯, বিআর১৭, বিআর১৮ পরিপক্ক অবস্থায় পানিতে তলিয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে  ব্রি ধান২৮, ব্রি ধান৪৫, ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৮৪, ব্রি ধান৮৮, ব্রি ধান৯৬ ইত্যাদি ব্যবহার করে আগাম পানিতে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে ফসল রক্ষা পেতে পারে। সঠিক সময়ে সঠিক জাত ব্যবহার করলে হাওরে ফসল হানির ঝুঁকি কমবে। সেক্ষেত্রে ১৫০ দিনের কম জীবনকাল সম্পন্ন জাত ১৫-২১ নভেম্বর পর্যন্ত বীজ বপন করতে হবে এবং ৩০-৩৫ দিনের চারা রোপণ করতে হবে। ১৫০ দিনের অধিক জীবনকাল সম্পন্ন জাত ১-৭ নভেম্বর পর্যন্ত বীজ বপন করতে হবে এবং ৩৫-৪৫ দিনের চারা রোপণ করতে হবে।

বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর ঠান্ডা প্রবণ এলাকা

এসব এলাকায় অনেক সময় বীজতলা ঠান্ডার প্রকোপে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে চারার গুণগত মান খারাপ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে ফলন কমে যায়। এ এলাকায় বেশিরভাগ কৃষকরা বোরো ধানের আগে আলু চাষ করে, যলে বোরো চাষে দেরি হয়ে যায়। ১৫ই ফেব্রুয়ারি বা তার পর তারা বোরো ধান রোপণ করে। এ সময় তাদের বীজতলায় চারার বয়স বেড়ে যায় ফলে ফলনে প্রভাব পড়ে। বীজতলায় ৩-৫ সে.মি. পানি ধরে রাখতে হবে এবং স্বচ্ছ পলিথিন সিট দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখতে হবে। দিনের বেলায় বেলা ১০:০০-১১:০০ টা থেকে র্সূযাস্ত র্পযন্ত স্বচ্ছ পলথিনি দিয়ে বীজতলা ঢেকে রাখলে ঢাকা অংশরে ভেতরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়, ফলে গুণগতমান সম্পন্ন চারার উৎপাদন সম্ভব হয়। শৈত্য প্রবাহের সময় স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে দিন ও রাত উভয় সময় বীজতলা ঢেকে রাখতে হবে, তবে রাতের বেলায় পলিথিনের কিছুটা অংশ খোলা রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রে চারার উপর জমাকৃত শিশির ঝরিয়ে দিতে হবে।  বীজতলার পানি সকালে বের করে দিয়ে পুনরায় নতুন পানি দিতে হবে, তবে এক্ষেত্রে টিউবওয়েলের পানি দিলে ভালো হয়।

দক্ষিণাঞ্চল বা লবণাক্ততা এলাকা

লবণাক্ততা এলাকায় কৃষকরা অনেক সময় স্থানীয় জাত চাষ করে। সেক্ষেত্রে  লবণাক্ততা সহিষ্ণু  ব্রি ধান৪৭, ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৯৭, ব্রি ধান৯৯, বিনা ধান৮ ও বিনা ধান১০ চাষ করতে পারে। দক্ষিণাঞ্চলে সাধারণত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ হতে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি থাকে। ফলে আগাম বীজতলায় বীজ ফেলে আগাম রোপণ করলে কুশি আসার সময় (মার্চ-এপ্রিল) লবণাক্ততাজনিত ক্ষতি থেকে ধানকে রক্ষা সম্ভব। ১৫ নভেম্বর বপন ও  ২৫ ডিসেম্বর রোপণ করতে হবে। লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাত সমূহ চাষ করলে ভাল ফলন পাওয়া যাবে।

লেখক: মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।

This post has already been read 4723 times!

Check Also

বারি ও সুপ্রিম সীড কোম্পানি লি: এর মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর

গাজীপুর সংবাদদাতা: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) এবং সুপ্রিম সীড কোম্পানি লিমিটেড এর মধ্যে এক …