বশেমুরকৃবি সংবাদদাতা: ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই) উদ্ভাবিত গমের ব্লাস্ট রোগ সহজে এবং দ্রুততম সময়ে শণাক্তকরণের জীবপ্রযুক্তি কৃষকদের মধ্যে সম্প্রসারণ এবং সহজলভ্য করার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি) এবং ওএমসি হেলথ কেয়ার লিমিটেড এর মধ্যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বুধবার (১০ মার্চ) বিকেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের অফিস কক্ষে উক্ত চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠিত হয়।
প্রযুক্তিটির উদ্ভাবক আইবিজিই এর পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. তোফাজ্জল ইসলামের উপস্থিতিতে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. গিয়াসউদ্দীন মিয়া এবং ওএমসি হেলথ কেয়ার লিমিটেড এর সিইও মো. মেজবাহুল কবির। চুক্তির ফলে বিশ^বিদ্যালয়ের আইবিজিই কর্তৃক উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি কৃষকদের দোড়গোরায় পৌঁছে যাবে। কৃষকরা সহজে এবং স্বল্পমূল্যে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গমের ব্লাস্ট রোগ নির্ণয় করতে পারবে বলে জানিয়েছেন ড. তোফাজ্জল।
এ সম্পর্কে বশেমুরকৃবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. গিয়াসউদ্দীন মিয়া বলেন, ওএমসির সাথে এই সমঝোতাচুক্তির ফলে দেশের কৃষকরা প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হবে। নতুন উদভাবিত এ জীবপ্রযুক্তিটি ব্যবহার করে তারা সহজে এবং স্বল্প মূল্যে গমের ব্লাস্ট রোগ শণাক্ত করতে পারবে।
ওএমসি হেলথ কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেড এর সিইও মো. মেজবাহুল কবির বলেন, গমের মারাত্বক ক্ষতিকর ব্লাস্ট রোগ শণাক্তকরনের এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তিটিকে কৃষক, গবেষক ও সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে সহজলভ্য ও সুলভমূল্যে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই কাজ করবে ওএমসি হেলথ কেয়ার লিমিটেড। আমরা আশাকরি, এই উদ্যোগ দেশের কৃষিকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি দেশের বাইরেও কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এ গবেষণা প্রকল্পের টিম লিডার এবং বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ইঞ্জিনিয়ারিং-এ প্রকাশিত এ প্রযুক্তির গবেষণা প্রবন্ধের একজন করেস্পন্ডিং লেখক বশেমুরকৃবির আইবিজিই’র অধ্যাপক ও পরিচালক ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম বলেন, এ জীবপ্রযুক্তিটি আবিষ্কারের জন্য আমরা ধান ও গমের ব্লাস্ট রোগের ছত্রাকের জীবন রহস্য বিশ্লেষণ করে ডিএনএ’র দ’ুটি সুনির্দিষ্ট ক্ষুদ্র অংশ (এমওটি-৬০৯৮ ও এমওটি-৬০৯৯) খুঁজে বের করি, যা শুধুমাত্র গমের ব্লাস্ট রোগের ছত্রাক জীবাণুর জিনোমে বিদ্যমান, কিন্তু ধানে ব্লাস্ট রোগ সংক্রমণকারী ছত্রাক জীবাণু ম্যাগনাপরথে অরাইজি অরাইজি (এমওও) এর জিনোমে নেই। ডিএনএ’র এ ক্ষুদ্র দু’টি অংশকে ভিত্তি করে পিসিআর পদ্ধতির মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট প্রাইমার ব্যবহার করে আমরা দক্ষিণ আমেরিকা ও বাংলাদেশ থেকে আহরিত গমের ব্লাস্ট রোগের ছত্রাক জীবাণুর শণাক্তকরণ নিশ্চিত করি। আমরাই প্রথম লুপ মেডিয়েটেড আইসোথার্মাল অ্যামপি¬ফিকেশন সংক্ষেপে ল্যাম্প এবং রিকম্বিনেজ পলিমারেজ অ্যামপি¬ফিকেশন (আরপিএ) প্রযুক্তির মাধ্যমে পিসিআর ব্যবহার না করে ছত্রাকটির ডিএনএ’র এই ক্ষুদ্র দু’টি অংশকে শণাক্ত করে গমের নমুনায় ছত্রাকটির উপস্থিতি সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করার প্রযুক্তি আবিষ্কার করি। গমের ব্লাস্ট রোগের ছত্রাক জীবাণু শনাক্তকরণের প্রযুক্তিকে আরো সহজতর ও সর্বসাধারণের ব্যবহার উপযোগী করার জন্য আমরা অধুনা কাস১২এ প্রোটিন, গাইড আরএনএ, রিকম্বিনেজ পলিমারেজ অ্যামপ্লিফিকেশন এবং নিউক্লিয়িক এসিড ল্যাটারাল ফ্লো ইমিউনোঅ্যাসে পদ্ধতির সমন্বয়ে একটি পিসিআরডি স্ট্রিপ আবিষ্কার করি যা অতি দ্রুত কৃষকের মাঠেই গবেষণাগারের কোন সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি ব্যতিরেকে ছত্রাকটি শনাক্ত করতে পারে। আমরা কৃষকের মাঠে রোগাক্রান্ত নমুনা সংগ্রহ করে এ পদ্ধতির কার্যকারিতা নিশ্চিত করেছি।
প্রযুক্তিটির গবেষণা প্রবন্ধের আরেকজন করেস্পন্ডিং লেখক, আমেরিকার ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. গুয়ো-লিয়াং ওয়াং বলেন, আমরা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি, যা গম শস্য আমদানী ও রপ্তানির সময় এবং বিকল্প পোষক উদ্ভিদে গমের ব্লাস্ট রোগের ছত্রাক জীবাণুর উপস্থিতি শণাক্ত করার ক্ষেত্রে বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রে (Plant Quarantine Centre) এবং কৃষকের মাঠে ব্যবহার করা যাবে। আমরা ছত্রাকটির জিনোমে দু’টি সুনির্দিষ্ট মার্কার শণাক্ত করেছি যা ঘাস জাতীয় অন্যান্য শস্য যেমন- ধান, বার্লি, সরগাম, ললিয়াম ইত্যাদিকে সংক্রমণকারি ছত্রাক জীবাণু ম্যাগনাপরথে অরাইজি এর জেনোমে নেই।
তিনি আরো বলেন, পিসিআরডি ষ্ট্রিপ পদ্ধতিতে খুব দ্রুুত সময়ে অর্থাৎ মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে ছত্রাকটিকে শণাক্ত করা যায়। পিসিআরডি ষ্ট্রিপ পদ্ধতিতে একটি নমুনা পরীক্ষা করতে মাত্র ৩০০-৪০০ টাকা খরচ হয় এবং গমের মাঠে সাধারণ তাপমাত্রায় এ পদ্ধতিতে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ছত্রাকটিকে দ্রুত শণাক্ত করা যায়।
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম গমে মহামারী আকারে ব্লাস্টরোগ দেখা দেয় এবং একযোগে দক্ষিণাঞ্চলের ৮ জেলার ১৫,০০০ হেক্টর জমির গম ফসল বিনষ্ট করে। পরবর্তীতে এটি খুব দ্রুত বাংলাদেশের ২০ জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের সেই সংকটকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর পরিচালক ড. তোফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে একদল গবেষক প্রথম গমের এই শত্রুকে চিহ্নিত করেন। তারা গবেষণা করে দেখেন যে ম্যাগনাপোর্থি ওরাইজি ট্রিটিকাম নামে এক ছত্রাকের আক্রমনে এই রোগ হয়। তারা গমের মহামারি ব্লাস্ট রোগের জীবাণুর জিনোম সিকুয়েন্স উম্মোচন করে রোগের উৎপত্তিস্থল নির্ণয় করেন এবং এই রোগ নির্ণয়ের সহজ মলিকুলার পদ্ধতিও আবিষ্কার করেন।
২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেমুরকৃবি) এর ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই), আমেরিকার ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইউনাইটেড স্টেট ডিপার্টমেন্ট অভ্ এগ্রিকালচার এবং চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্স এর বিজ্ঞানীরা যৌথ গবেষণায় একটি জীবপ্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে যা দ্রুত, সহজে, কম খরচে এবং সুনির্দিষ্টভাবে গমের ব্লাস্ট রোগের সংক্রমণকারী ছত্রাক জীবাণু ম্যাগনাপরথে অরাইজি ট্রিটিকাম (এমওটি) কে শণাক্ত করতে পারে। নতুন আবিষ্কৃত এ জীবপ্রযুক্তিটি খুব সহজে গমের ব্লাস্ট রোগের ছত্রাক জীবাণু সুনির্দিষ্টভাবে শণাক্ত করতে ব্যবহার করা যাবে এবং গমের এ ধ্বংসাত্মক রোগ দমনে এবং ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে বলে দাবী করেছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকগণ।