মোজাম্মেল কবির: বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর হাতে বর্তমানে যে সংখ্যক পারমাণবিক বোমা আছে শোনা যায়, এমন গোটা দশেক পৃথিবী ধ্বংস স্তূপে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে। তাহলে বলতে হয়, মুহূর্তে মানব সভ্যতা বিলুপ্তির ক্ষমতা মানুষেরই হাতে। এরপরও বিশ্ববাসীর মনে কোনো আতঙ্ক নেই। কেননা, অস্ত্রগুলোর ব্যবহার মানুষের নিয়ন্ত্রণে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন পৃথিবীতে পারমাণবিক অস্ত্রের চেয়েও ভয়াবহ আতংকরে বিষয় হচ্ছে লাখ লাখ বছর ধরে সুপ্ত থাকা পৃথিবীর অজানা ভাইরাস, যেখানে মানুষের নিয়ন্ত্রণ নেই। মানব সভ্যতা বিলুপ্তির জন্য এমন কিছু প্রাণঘাতী ভাইরাসই যথেষ্ট। সাম্প্রতিক সময়ের কোভিড ১৯ ভাইরাস আধুনিক বিশ্বকে নাড়া দিয়ে বুঝিয়ে যাচ্ছে তার ক্ষমতা কতোটা বিধ্বংসী হতে পারে। কোটি মানুষকে আক্রান্ত করে লাখ লাখ মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে। বিশ্বের অর্থনীতিকে স্থবির করে দিয়েছে। বিশ্বের লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। কোটি কোটি মানুষ আজ কর্মহীন। বিশ্বের বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোকে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে দেখা গেছে অদৃশ্য এই ভাইরাসের আক্রমণের কাছে।
যদিও গত প্রায় দুই বছরে এই ভাইরাসটিকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসার অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বের বিজ্ঞানীরা, তারপরও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে এই কোভিড ১৯ কি শেষ আঘাত? এর থেকে রক্ষা পেলেই কি বিশ্ববাসী নিরাপদ? বিজ্ঞানীরা আগেই সতর্ক করেছিলেন যে, পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বরফ গলে যাওয়ায় আমরা অনেক অজানা প্রাচীন রোগ-জীবাণু দেখতে পাবো। গবেষকরা বলেছেন, এমন অনেক ভাইরাস হাজার হাজার বছর ধরে হিমবাহ এবং ভূগর্ভস্থ চির হিমায়িত অঞ্চলে সুপ্ত অবস্থায় আছে। বরফ গলে যাওয়ায় এইগুলো আবার জেগে উঠতে পারে। ২০২০ সালের শুরুর দিকে তিব্বতের গুলিয়া আইস ক্যাপ থেকে দুটি আইস কোর নমুনা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এমন কিছু ভাইরাস চিহ্নিত করেছেন। এদের মধ্যে একটি নমুনা ৫২০ বছর এবং অন্যগুলো ১৫ হাজার বছর আগের। এগুলোর মধ্যে আবার ৪টি প্রজাতি ও পরিবার সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ইতিপূর্বে জানাশোনা থাকলেও বাকিগুলো সম্পর্কে তাঁদের কোনো ধারণাই নেই। বিজ্ঞানীরা হুঁশিয়ার করে দেন যে, হাজার হাজার বছর ধরে বরফের নিচে আটকে থাকা অজানা ভাইরাসগুলো আবার পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে সভ্যতার বিপর্যয় ঘটাতে সক্ষম।
ফ্রান্সের জিনোমিক্স এবং বায়োইনফরম্যাটিক্সের অধ্যাপক ক্লেভারি এই গবেষণা সম্পর্কে বলেছেন, প্রাচীন এই ভাইরাসগুলোকে আমরা স্মলপক্স ভাইরাস বলে মনে করি, যা পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়েছিল। আমাদের ধারণাটি ভুল। তিনি আরো বলেন, অতীতের এসব ভাইরাসের অস্তিত্ব এখনো থাকতে পারে যে সব ভাইরাসের বিরুদ্ধে আধুনিক ওষুধ কাজ করবে না। অ্যানথ্রাক্স সৃষ্টিকারী ব্যাকটিরিয়াগুলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে। ২০১৪ সালে ক্লেভারি নিজের একটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেন, সাইবেরিয়ান ভূগর্ভস্থ চির হিমায়িত অঞ্চলে ৩০,০০০ বছরের পুরনো দৈত্য ভাইরাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। ৩০,০০০ বছর সুপ্ত থাকার পরেও ল্যাবরেটরিতে এই ভাইরাসটির সংক্রামক ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার প্রমাণ মিলেছে। ভাইরাসটি দৈত্য আকৃতির হিসেবে উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে- গড় আকৃতির একটি ভাইরাসের আকার সাধারণত ২০ ন্যানোমিটার হয়ে থাকে, কিন্তু ওই ভাইরাসটির আকার ২০০ ন্যানোমিটারের অধিক। এটি একটি সাধারণ মাইক্রোস্কোপের নিচে রাখলেও দেখা যায়।২০১৪ সালে পিথোভাইরাস সাইবেরিকাম ও মোলিভাইরাস সাইবেরিকাম নামে পৃথক ভাইরাস আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীরা যাদের বয়স ৩০,০০০ বছর।
আশার কথা হচ্ছে, ভাইরাস দুটি অ্যামিবাকে আক্রমণ করে এককোষী জীবের আকৃতি ধারণ করতে সক্ষম কিন্তু মানুষ কিংবা জন্তু-জানোয়ারকে আক্রমণ করতে পারে না। পাশাপাশি বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা যে, যেহেতু এই ভাইরাসগুলো হাজার হাজার বছর পরেও সক্রিয় হতে সক্ষম সেখানে বরফের নিচে এমন ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকতে পারে যা মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর জন্য মারাত্মক প্রাণঘাতী। ভাইরাস কোনো জীবিত জিনিস নয়। এদের সক্রিয় হতে এবং পুনরুৎপাদন করতে অবশ্যই একটি জীবের কোষে প্রবেশ করতে হবে। জীব কোষের বাইরে এদেরকে সক্রিয় ভাইরাসের বীজ হিসাবে কল্পনা করা যায়। তার মানে এরা মারা যায় না, অঙ্কুরিত হয়ে সংক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকে।
সাম্প্রতিক সময়ে একটি বিষয় প্রমাণিত হয়েছে যে, ভূপৃষ্ঠের বরফ গলার হার ক্রমশই বেড়ে চলেছে। বছর দুয়েক আগে বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন যে, আর্কটিক অঞ্চলে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের চাইতে দ্বিগুণ গতিতে বরফ গলছে। আর্কটিক মহাসাগর সংলগ্ন সমুদ্র এবং আলাস্কা, কানাডা, ফিনল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, রাশিয়া এবং সুইডেনের কোনো কোনো অংশ নিয়ে গঠিত আর্কটিক অঞ্চল। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃদেশীয় প্যানেল (আইপিসিসি) -এর রিপোর্টে দেখা গেছে যে, ইউরোপ, পূর্ব আফ্রিকা এবং অন্যান্য অঞ্চলের হিমবাহগুলো শতাব্দীর শেষের দিকে ৮০ শতাংশেরও বেশি বরফ গলে যেতে পারে।
বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যৎবাণী করেছেন যে, আমরা যদি শিল্প বিপ্লবের আগের সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেও সীমাবদ্ধ রাখতে পারি এরপরেও ৪০ শতাংশ বরফ গলে যাবে। বরফ গলে ভূগর্ভস্থ চির হিমায়িত অঞ্চল থেকে প্রাচীন ভাইরাসগুলো বের হয়ে আসলে পৃথিবীতে এর কী প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে তা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো অজানা। তবে কোনো কোনো জীবাণু বেশ শক্তিশালী হয়ে থাকে এবং অন্যদের চেয়ে সংক্রামক হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। উদাহরণস্বরূপ অ্যানথ্রাক্সের মতো বীজ উৎপাদক ব্যাকটিরিয়ার কথাই বলা যেতে পারে- অ্যানথ্রাক্স কোনো প্রাচীন রোগ নয়, এটি পৃথিবীর মাটিতে পাওয়া যায়। তবে এটি ‘জম্বি প্যাথোজেন’ নামে পরিচিত। কারণ এটি নতুন প্রাদুর্ভাব সৃষ্টির জন্য পুনরায় সক্রিয় হওয়ার আগে শত বছর ধরে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে সক্ষম।
২০১৬ সালে উত্তরপূর্ব রাশিয়ার সালেখার্ড নামক এলাকায় ১২ বছরের এক বালক অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত হয়ে মারা যায় এবং আরো বেশ কিছু মানুষ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। এই রোগটিকে তারা সাইবেরিয়ান প্লেগ বলছিল। পরবর্তীতে জানা যায় যে, ৭৫ বছর আগে একই রোগে আক্রান্ত মানুষসহ জীবজন্তুর কবর বরফের নিচ থেকে বের হয়ে আসলে ওই রোগটি সক্রিয় হয়ে আবার সংক্রমণ করতে সক্ষম হয়।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে হাজার বছর ধরে সুপ্ত থাকা ভাইরাস এবং ব্যাকটিরিয়ার আক্রমণে ভবিষ্যতে এই ধরনের প্রাদুর্ভাবের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে।
অ্যানথ্রাক্সের মতো তথাকথিত জম্বি রোগ বা প্যাথোজেনগুলির গল্প অনেক মিডিয়ার মনোযোগ পেয়েছে, তবে প্রকৃত ঘটনা এখনো পর্যন্ত বিরল। বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করেন যে, প্রাচীন রোগের আশঙ্কা অনেকটাই অতিরঞ্জিত, তবে এটিও সত্যি যে, আমরা ভাইরাসগুলোর খুব কাছাকাছি আছি। আমেরিকার রুটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন অ্যান্ড কোস্টাল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের বায়োলজিক্যাল সমুদ্রবিদ পল ফ্যালকোভস্কি বলেন, প্রাচীন ভাইরাসগুলোর সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করার ক্ষেত্রে এর বাহক সম্পর্কে চিন্তা করাও গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যালকোভস্কি বলেছিলেন, বেশিরভাগ সংক্রামক রোগ প্রত্যক্ষ যোগাযোগ, শারীরিক তরল এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রামিত হয়। তিনি মূলত বুঝাতে চেয়েছিলেন, কার্যত দীর্ঘ পরিসরের সংক্রমণ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
বিশ্বে কভিড ১৯ এর সংক্রমণের আগে বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা প্রাচীন ভাইরাসকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণের বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব দেননি। তাঁরা বিষয়টি এভাবে ভেবেছেন যে, সাইবেরিয়া কিংবা তিব্বতের মতো বিচ্ছিন্ন এলাকায় আবিষ্কৃত ভাইরাসটি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য তেমন ঝুঁকিপূর্ণ হবে না। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে আগামী দিনগুলোর কথা ভেবে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হচ্ছেন। সামনের দিনগুলোতে অত্যন্ত আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে আর্কটিক অঞ্চলে একদিকে বরফ গলে যাওয়ার পাশাপাশি বর্তমান প্রশাসনের বরফের নিচ থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের নীতির কারণে প্রাচীন অজানা ভাইরাসগুলো গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
মাইক্রোবায়োলজির প্রফেসর ক্রেউডার জনসন এবং তাঁর সহকর্মী ট্রেসি গোল্ডস্টেইন বলেছেন এর ফলে প্রাণী ও অণুজীবগুলোকে বিভিন্ন উপায়ে ইন্টারঅ্যাক্ট করতে বা প্রথমবারের জন্য প্যাথোজেনগুলোর সংস্পর্শে আসতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফোসিন ডিসটেম্পার ভাইরাস সম্পর্কে গবেষণার কথা উল্লেখ করেন, এটি একটি সম্ভাব্য মারাত্মক সংক্রামক রোগ, যা সীল ও অন্যান্য সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আক্রমণ করে।
গোল্ডস্টেইন বলেছিলেন, ‘এটি কেবল আমাদের মনে রাখা উচিৎ জলবায়ু এত তাড়াতাড়ি পরিবর্তিত হচ্ছে এবং পরে কী উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে তা আমরা জানি না।’ক্লেভারি সম্মত হন, ‘পূর্বের জনশূন্য আর্কটিক অঞ্চলে বেশি লোকের সমাগম বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।’
কোভিড ১৯ ভাইরাস আক্রমণের শুরুতে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় অনেক রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের দায়িত্বশীল আচরণ আমাদের চোখে পড়েনি। অনেককেই এই ভাইরাস সম্পর্কে তুচ্ছ-তাছিল্য এবং হাস্যকর মন্তব্য করতে দেখেছি আমরা। এখন পর্যন্ত রহস্যজনক থেকে গেছে কোভিড ১৯ এর উৎপত্তিস্থল কোথায় ছিল। এক দেশ অন্য দেশকে দোষারোপ করে অনেকটাই কালক্ষেপণ করেছে, যা পরবর্তীতে ক্রমবর্ধমান বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়। পরিবর্তনশীল চরিত্রের এই ভাইরাসটির ভ্যাকসিন নিয়ে এখনো দেশে দেশে গবেষণা চলছে। শতভাগ কার্যকারিতার নিশ্চয়তা না থাকলেও ভ্যাকসিন আবিস্কার হওয়ার পর বশেীরভাগ দশে প্রয়োগ করেছে। এরপরও প্রতিনিয়ত পরর্বিতনশীল কোভিড ১৯ ভাইরাসের শতভাগ কার্যকর ভ্যাকসিন হাতে পেলেই নিরাপদ করতে পারবো বিশ্ববাসীকে এর কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? বরফের নিচে সুপ্ত হাজার হাজার বছরের পুরনো প্রাণঘাতী ভাইরাস একের পর এক আক্রমণ করবে না এই নিশ্চয়তা বিজ্ঞানী কিংবা বিশেষজ্ঞ মহল দিতে পারছেন না।
তথ্যসূত্র: নিউজ উইক অনলাইন, বিবিসি, সাইন্টিফিক আমেরিকা অনলাইন
লেখক: কথাসাহিত্যিক