বুধবার , নভেম্বর ২৭ ২০২৪

সয়াবিন তেলের বিকল্প হতে পারে রাইস ব্রান অয়েল

কৃষিবিদ এম আব্দুল মোমিন : ‘রাইস ব্রান’ হচ্ছে ধানের ওপরের শক্ত আবরণের নিচে চালের ওপরের পাতলা ‘মেমব্রেন’ যা আমাদের দেশে চালের কুড়া নামে পরিচিত। অর্থাৎ ধান ভাঙলে ধানের ওপরের শক্ত আবরণ থেকে বের হয় ভূষি এবং মেমব্রেন থেকে বের হয় ব্রান বা কুড়া। ধানের তুষ তুলে ফেললে যে চাল পাওয়া যায় তার ওপর একটি লালচে খোসা থাকে। ওই খোসাই রাইস ব্রান। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ^বাজারে সয়াবিন তেলের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির কারণে দেশীয় বাজারে এর মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। বর্তমানে প্রতিলিটার সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে বিকল্প হিসেবে রাইস ব্রান অয়েল ব্যবহারের কথা ভাবছেন ভোক্তরা। কেননা, রাইস ব্রাান অয়েল সয়াবিন তেলের মতোই একটি ভোজ্য তেল যাতে ক্ষতিকর কোলেস্ট্রেরল নেই। উপরন্তু এটি প্রাকৃতিক ভিটামিন, এন্টি অক্সিডেন্ট ও খনিজ উপাদানে সমৃদ্ধ। রাইস ব্রাান থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংগৃহীত ও পরিশোধিত ভোজ্য তেলই হচ্ছে রাইস ব্রান অয়েল। রাইস ব্র্যান অয়েলে রয়েছে ক্যান্সার প্রতিরোধক গামা ওরাইজেনল, যা শক্তিশালী এন্টি অক্সিড্যান্ট হিসেবে একমাত্র চালের গুড়োতেই পাওয়া যায়। এতে ভিটামিন এ, ডি, ই ও ওমেগা৩ আছে, যা রক্তের LDL (মন্দ কোলেস্টেরল) মাত্রা কমিয়ে এবং HDL (ভালো কোলেস্টেরল) মাত্রা বাড়িয়ে হৃদেরাগের ঝুঁকি প্রতিরোধে ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থার মতে, ভোজ্যতেলে যেসব খাদ্যগুণ থাকা উচিত, তা জলপাই তেলের পর সবচেয়ে বেশি রয়েছে রাইস ব্র্যান অয়েলে।

বাংলাদেশে রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদন
পাবনার ঈশ্বরদীতে ২০১১ সালে রশিদ অয়েল মিলস লিমিটেড হোয়াইট গোল্ড ব্র্যান্ড নামে রাইস ব্রান অয়েলের উৎপাদন শুরু করে। বর্তমানে সিলেটের ইমেরাল ওয়েল ইন্ডাষ্টিজ লিঃ, শেরপুরের এমারাল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ, ঢাকার ধামরাই-এ কেবিসি এগ্রো প্রোডাক্টস প্রাঃ লিঃ সহ বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে এই তেল বানিজ্যিকভাবে উৎপাদন করছে। বাংলাদেশে ১৫টি রাইস ব্রান অয়েল মিলের মধ্যে বতর্মানে চালু ১৩টির উৎপাদন মতো। এর উৎপাদন ক্ষমতা ২ লাখ ৫৮ হাজার মেট্রিক টন হলেও বতর্মানে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র প্রায় ১ লাখ মেট্রিক টন রাইস ব্রান অয়েল।একটি সূত্রে জানা গেছে, ভারত ও পাকিস্তানে এই চাহিদা ১৪ কেজি। দেশে সয়াবিন তেলের বাৎসরিক চাহিদা জনপ্রতি ৯.৭০ কেজি। এ হিসাবে বাংলাদেশে ১৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের জনপ্রতি বছর সয়াবিন তেলের চাহিদা ১৬ লক্ষ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো সয়াবিন তেল উৎপাদন হয় না তবে স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশে প্রায় ২ লক্ষ মেট্রিক টন সরিষা, বাদাম, তিল, পাম জাতীয় তেল উৎপাদন হচ্ছে। বাকি প্রায় ১৪ লক্ষ মেট্রিক টন অপরিশোধিত তেল আমদানি করতে ক্রয় বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে এবং বাংলাদেশে এনে অপরিশোধিত তেল পরিশোধিত করতে হয়। এ জন্য আছে ১০টির অধিক অয়েল রিফাইনারি। বাংলাদেশে ১৬টি রাইস ব্রান অয়েল মিলের মধ্যে বর্তমানে চালু ১৩টির মোট উৎপাদন সক্ষমতা ২ লক্ষ ৫৩ হাজার মেট্রিক টন (এফএমপিএচিটি বিভাগ, ব্রি, ২০১৫)।

বাংলাদেশে ধান উৎপাদন হয় প্রতি বছর ৫ কোটি ৭৫ লক্ষ মেট্রিক টন প্রায়। চাল কলে ধান থেকে চাল তৈরি করলে ৭ থেকে ৮ শতাংশ ব্রান পাওয়া যায়। এ থেকে চাল পাওয়া যায় ৬৭% অর্থাৎ ৩৭৬ লক্ষ মেট্রিক টন। এ ৩৭৬ লক্ষ মেট্রিক টন রাইস/চাল থেকে ব্রান পাওয়া যায় প্রায় ৩৬ লক্ষ মেট্রিক টন। এই ৩৬ লক্ষ মেট্রিক টন রাইস ব্রান থেকে অপরিশোধিত তেল পাওয়া যাবে ৮ লক্ষ মেট্রিক টন এবং অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করার পর কমে গিযে দাঁড়াবে মাত্র ৭.১৬ মেট্রিক টনে। বর্তমানে রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার মানুষের। বিনিয়োগ হয়েছে আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা। ভোজ্যতেলের মোট চাহিদায় ব্রান অয়েল এর অবদান প্রায় ২.৫ শতাংশ। দাম একটু বেশি হলেও রাইস ব্রান অয়েল রান্নায় অন্যান্য তেল থেকে ২০-২৫% কম লাগে। এ জন্য বিশ্ববিখ্যাত অনেক পুষ্টি বিজ্ঞানী এবং হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী রাইস ব্রান অয়েলের গুণে পঞ্চমুখ।

ব্রান অয়েলের উপকারিতা
রাইস ব্রাান অয়েলে রয়েছে সর্বাধিক পরিমাপ ‘অরাইজনাল’(Oryzonal) যা দেহের জন্য ক্ষতিকর কোলেস্ট্ররল কমাতে সাহায্য করে এবং দেহের জন্য উপকারী কোলেস্ট্ররল বৃদ্ধি করে হার্টকে সতেজ ও নিরাপদ রেখে হার্ট এ্যাটাক প্রতিরোধে সহায়তা করে। এটা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং পাকস্থলী ও কোলন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে। এ জন্য জাপানে এ তেলকে বলা হয় ‘হার্ট গার্ড অয়েল’। মোট কথা পুষ্টি প্রযুক্তির বহুমাত্রিক উন্নয়নে বিজ্ঞানীদের অনুসন্ধানে রাইস ব্রান অয়েল এন্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা শারীরিক রোগ প্রতিরোধ (IMMUNITY) ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তাছাড়া রাইস ব্রান  অয়েল আছে প্রাকৃতিক গুণসম্পন্ন উচ্চমানের ভিটামিন ই টকোফেরল ও টকোট্রিনল (Tocopherol and Tocotrienol)। এ ধরনের এন্ট্রিঅক্সিডেন্ট দেহের ফ্রি রেডিকেল প্রতিরোধ করে এবং ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। এতে সব প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে বিধায় রাইস ব্রান অয়েল চর্মরোগ প্রতিরোধ করে চর্মের মসৃণতা বৃদ্ধি করে। এতে রয়েছে পাইটোস্টেরল (Phytosterols) যা কোলেস্ট্ররলের মাত্রা কমিয়ে রোগ প্রতিরোধ মাত্রা বাড়ায়। ইহা রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রেখে রক্তচাপ কমায় এবং ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে রাখে।

বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীরা যা বলেন
রাইস ব্রান অয়েল কোলেস্ট্ররলমুক্ত, ইহা  হার্টএ্যাটাকের ঝুঁকি কমায় এবং ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণে রাখে ও ক্যান্সার প্রতিরোধ করে এ কথা স্বীকার করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং ভারতসহ বিভিন্নদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া  ইউনিভার্সিটির মেডিসিন বিভাগের ড. এএল জারহার্দিদ (Dr. A.L. Gerhardit) বলেছেন, আমেরিকান হার্ট এ্যাসোসিশেন দ্বারা স্বীকৃত যে, বাজারে বহু তেলের মধ্যে সুষম এবং বহুমুখী কর্মশক্তি সম্পন্ন তেল হচ্ছে রাইস ব্রান অয়েল। ভারত সরকারের খাদ্য এবং ভোগ্যপণ্য মন্ত্রণালয়ের ভোজ্য তেল বিষয়ক কমিশনার ডা. এম কেকু  বলেন, রাইস ব্রান অয়েল জাপান, চীন ও অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোতে ভোজ্য তেল হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং  জাপানে এ তেল ‘হার্ট অয়েল’ নামে পরিচিত।

সম্ভাবনা সীমাবন্ধতা
সয়াবিন, সরিষা, সূর্যমুখী ও পাম অয়েলসহ এখন পর্যন্ত যত রকমের ভোজ্যতেল ব্যবহার হচ্ছে, তার কোনোটির কাঁচামালেই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় বাংলাদেশ। ফলে চাহিদা অনুযায়ী ভোজ্যতেলের সরবরাহ সচল রাখতে এসব তেলের কাঁচামাল অথবা ক্রুড বিদেশ থেকে আনতে হয়। এর বিপরীতে রাইস ব্র্যান অয়েলের কাঁচামাল অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেই পুরোপুরি জোগান পাওয়া যায়। দেশের ধানকলগুলোয় উপজাত হিসেবে এটি তৈরি হয়। রাইস ব্রান তেল উৎপাদনের সম্ভাবনা ও সীমাবন্ধতা নিয়ে দেশের বিখ্যাত হেলথকেয়ার রাইস ব্রান অয়েল প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কেবিসি এগ্রো. প্রডাক্টস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুধীর চৌধুরীর জানান, মূলত রাইস ব্রান অয়েলের উৎপাদন চালের কুড়া দিয়ে। বাংলাদেশে উৎপাদিত ধান থেকে বার্ষিক কুড়া উৎপাদন হয় প্রায় ৪০ লক্ষ মেট্রিক টন। যা পর্যাপ্ত নয় তারপরও কুড়া রফতানি হয় এবং পোল্ট্রি ও ফিস ফিড হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া ২০% হলার মেশিন থেকে উৎপন্ন কুড়া ও ৫% আতপ চালের কুড়া এবং ২৫% পোল্ট্রি ও ফিস ফিডে ব্যবহৃত কুড়া অর্থাৎ মোট উৎপাদিত কুড়ার অর্ধেক রাইস ব্রান অয়েল উৎপাদনে ব্যবহৃত করা যাচ্ছে না। এ সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠে রাইস ব্রান তেলের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে কুড়া রফতানি বন্ধ, পোল্ট্রি ফিড ও ফিস ফিডে রাইস ব্রানের পরিবর্তে অন্য উপাদান ব্যবহার নিশ্চিত, এঙ্গেল বার হলার রাইস মিলগুলোকে রাবার রোল হলার মিল (সেমি. অটোরাইস মিল) অথবা পূর্ণাঙ্গ অটো রাইস মিলে রূপান্তরিত করা জরুরী। এঙ্গেল বার রাইস মিল (ম্যানুয়েল) এর কুড়াও রাইস ব্রান তেল তৈরির অনুপযোগী। উৎপাদন বৃদ্ধিতে রাইস ব্রান অয়েল মিলগুলোতে গ্যাস সংযোগ জরুরী প্রয়োজন। তাছাড়া রাইস ব্রান অয়েল মিলে  রাইস ব্রান অয়েল ছাড়াও বাৎসরিক ১২ লক্ষ ৬০ হাজর মেট্রিক টন ফিড উৎপাদন হচ্ছে যা দেশের পোল্ট্রি ও ফিস ফিডের চাহিদা মিটিয়ে অবশিষ্টগুলো বিদেশে রফতানি করার নতুন বাজার সৃষ্টি সম্ভব হবে। তবে ব্যাপকভাবে রাইস ব্রান অয়েল মিল নির্মাণের অনুমতি দেয়ার আগে কাঁচামাল অর্থাৎ কুড়া প্রাপ্তির নিশ্চয়তার কথা ভাবতে হবে সরকারকে। চালের কুড়ার অভাবে মিলগুলো যেন বন্ধ না থাকে। জাতীয় স্বার্থে এ শিল্পের প্রসারে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে এবং একই সাথে রাইস ব্রান অয়েলের মান ঠিক রাখতে হবে।

উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের মতামত
এমারাল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ হাসিবুল গণি বলেন, ধান উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। সে জন্য দেশে যে পরিমাণ ব্রান উৎপাদিত হয় তার সঠিক ব্যবহার করতে পারলে ভবিষ্যতে বিদেশ থেকে হয়তো আর ভোজ্যতেল আমদানি করতে হবে না। তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, কুড়া বা ব্রান থেকে ২০ থেকে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত অপরিশোধিত তেল পাওয়া যায়। সেটাকে পরিশোধনের পর বোতলজাত করে বিপণন করা হয়। সাড়ে ছয় কেজি কুঁড়ায় এক লিটার তেল হয়। জানা গেছে  ব্রান অয়েলের সম্ভাবনার কারণেই বর্তমান উৎপাদনক্ষমতা দ্বিগুণ করছে এমারেল্ড অয়েল লিমিটেড (স্পন্দন ব্র্যান্ড)। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিদিনকার উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৪০টন।

দেশে ব্রান তেল উৎপাদনকারী প্রথম প্রতিষ্ঠান রশিদ অয়েল মিলের বিপণন ও বিক্রয় বিভাগের প্রধান বলেন, ‘দেশে প্রতিবছর ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে এ তেলের বাজার বাড়ছে। এটি অনেক বেশি বাড়তে পারত যদি আমরা আরও বেশি উৎপাদন এবং প্রচারণা চালাতে পারতাম।

মজুমদার প্রডাক্টস (স্বর্ণা ব্র্যান্ড) প্রতিদিন তেল উৎপাদন করে ৯০ থেকে ১০০ টন। প্রতিষ্ঠানটির কারখানা বগুড়ার শেরপুরে। প্রতিষ্ঠানের সহকারী মহাব্যবস্থাপক রহমতুল্লা বলেন, চাহিদা বাড়ায় আরও ১৫০ টন (প্রতিদিন) তেল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে।

লেখক: উর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।

This post has already been read 4129 times!

Check Also

ডিম ও মুরগির বাজার স্থিতিশীলতায় দরকার  “জাতীয় পোল্ট্রি বোর্ড” গঠন

কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার : পোল্ট্রি শিল্পের সাথে আন্ত:মন্ত্রনালয়, আন্ত:অধিদপ্তর  এবং উৎপাদন ও বিপননে ডজনের উপরে …