বৃহস্পতিবার , ডিসেম্বর ২৬ ২০২৪

খুলনার এক সময়ের প্রমত্তা হামকুড়া নদীর বুক এখন বিস্তীর্ণ এক জনপদ

প্রমত্তা হামকুড়া নদী এখন বিস্তীর্ণ এক জনপদ

ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : খুলনা জেলার  ডুমুরিয়া উপজেলার বালিয়াখালী সেতুর পশ্চিম পাশের উঁচু সড়ক থেকে দক্ষিণে তাকালেই দেখা মেলে একটি সড়কের। সেই সড়কটি গিয়ে শেষ হয়েছে হামকুড়া নদীতে। একসময় ফেরির মাধ্যমে নদীটি পার হতে ওই সড়ক দিয়েই ঘাটে যেতে হতো। বালিয়াখালী সেতু হওয়ার পর ওই সড়ক আর ব্যবহার হয় না। বর্তমানে ফেরি পারাপারের সেই সড়ক এমনকি সেতুটি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেও নেই নদীর কোনো অস্তিত্ব।

খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া ফলক আছে, নদীর উপর ব্রীজ আছে, কিন্তু ব্রীজের নীচে সেই নদী আর নেই!সেতুটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে এর দুই পাশে যতদূর চোখ যায় নদীর বদলে দেখা যায় শুধু ধানক্ষেত। একসময় এখান দিয়ে যে একটি নদী বয়ে গিয়েছিল, সেতুটিই তার প্রমাণ। যে সে নদী নয়, হামকুড়া নদীকে একসময় প্রমত্তা হিসেবেই দেখেছে স্থানীয়রা। ডুমুরিয়া উপজেলার বুক চিরে বয়ে চলা হামকুড়ার বুক এখন বিস্তীর্ণ এক জনপদ। মাত্র দুই যুগ আগেও যে নদী দিয়ে ছোট-বড় অসংখ্য নৌকা, ইঞ্জিনচালিত ট্রলার আর লঞ্চ চলেছে- সেই নদীর বুকে গড়ে উঠেছে এখন শত শত ঘর-বাড়ি। গড়ে উঠেছে ইটভাটা, স্কুলসহ নানা প্রতিষ্ঠানও।

যে যার মতো ভরাট হওয়া নদীর বুক দখল করে রেখেছেন। ভবিষ্যতে খনন করে নদীটিকে আবারও স্রোতস্বিনী করার জায়গাও এখন আর ফাঁকা নেই। দুটি নদীর সংযোগ ছিল হামকুড়া। এর উত্তরে শ্রীনদী, দক্ষিণে ভদ্রা। শ্রীনদী থেকে উৎপত্তি হয়ে বিস্তীর্ণ বিল ডাকাতিয়ার মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে দক্ষিণ ভদ্রায় গিয়ে মিশেছে হামকুড়া। আশির দশকের শুরুতে বিলডাকাতিয়া অঞ্চলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হলে ওই অঞ্চলের মানুষ বিলডাকাতিয়ার আমভিটাসহ চারটি স্থানের বাঁধ কেটে দেয়। এতে বিলের সঙ্গে নদীটির সরাসরি সংযোগ তৈরি হয়। ভদ্রার জোয়ারের পানি হামকুড়া হয়ে বিল ডাকাতিয়ায় উপচে পড়ে।

বছর দুয়েক পর কে-জেডিআরপি (খুলনা-যশোর ড্রেনেজ রিহ্যাবিলিটেশন প্রজেক্ট) প্রকল্প বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাঁধের কাটা অংশ আটকে দিলে মাস তিনেকের মধ্যেই শুকিয়ে যায় হামকুড়া। সেই থেকে নদীটির ওপর ছোট-বড় নানা স্থাপনা নির্মাণ শুরু করে স্থানীয় লোকজন।

ডুমুরিয়ার হামকুড়া নদীটির দৈঘ্য প্রায় ১৪ কিলোমিটার। উপজেলার থুকড়া, রূপরামপুর, গজেন্দ্রপুর, শাহপুর, মধুগ্রাম, হাসানপুর, মিকশিমিল, বালিয়াখালীসহ কয়েকটি গ্রামের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এই নদী। কিছুদিন আগে হওয়া বৃষ্টির পানি জমিতে আটকে গেছে। এতে ধানক্ষেত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগ স্থানেই নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। শুধু আমভিটা এলাকায় থাকা নদীর অংশটুকুতে কিছুটা পানি রয়েছে। তবে তা কচুরিপানায় পরিপূর্ণ। সেখানে নদীর প্রস্থ এখন ১০ মিটারেরও কম। এ ছাড়া অন্যান্য এলাকায় নদীর বুকজুড়ে চলছে চাষাবাদ। কিছু কিছু জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে ছোট বড় স্থাপনা, রয়েছে ইটভাটাও। এমনকি বালিয়াখালী সেতুর পশ্চিম পাশের ঠিক নিচেও গড়ে তোলা হয়েছে কয়েকটি মাটির ঘর।

সেতুর নিচে যারা ঘর করে আছেন তাদের একজন আব্দুস সালাম বিশ্বাস। তার স্ত্রী মমতাজ বেগম জানান, প্রায় ২০ বছর ধরে সেতুর নিচে তারা পরিবার নিয়ে বাস করছেন। ঘর-বাড়ি ও জমি না থাকায় তারা সেতুর নিচে আশ্রয় নিয়েছেন। যদি কখনও নদী খনন হয় তাহলে তারা অন্যত্র চলে যাবেন।

নদীসংলগ্ন এলাকাগুলোর অন্তত ১৫ জনের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। এর মধ্যে নদীসংলগ্ন বিলে জমি আছে এমন ৫ জনকে পাওয়া যায়। তাদের সবাই এখন চান- নদীটি খনন করা হোক। তাদের দাবি, যারা নদীর অবৈধ জমি দখল করে আছেন, নদী খনন হলে তারা ছাড়া সবাই খুশি হবেন। এলাকার মানুষের দুর্ভোগ কমবে। উপজেলার অন্তত ১০টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর জমির জলাবদ্ধতা দূর হবে। বাড়বে ফসলের উৎপাদনও। এলাকার মানুষের মাছের চাহিদাও পূরণ হবে এই নদী থেকে।

খুলনা অঞ্চলের নদ-নদী নিয়ে প্রায় ২৫ বছর ধরে গবেষণা করছেন গৌরাঙ্গ নন্দী। তিনি বলেন, উপকূলীয় এলাকার নদী জীবিত রাখার শর্ত হচ্ছে, উজান-ভাটা উভয় দিকে প্রবাহ বজায় রাখা। এই অঞ্চলের নদীগুলোর বেশির ভাগই উজান থেকে বিচ্ছিন্ন। এ জন্য জোয়ারের চাপ বেশি ও জোয়ারে আসা পলিমাটি বেশি পরিমাণে নদীগর্ভে জমা হয়। হামকুড়া নদীর উজানের অংশও বন্ধ রয়েছে। ফলে জোয়ারে আসা পলিমাটি জমা হয়ে নদীটি মারা গেছে। তিনি মনে করেন, নদীটি খনন করে টিআরএম (টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট) করলে আবার খরস্রোত ফিরে পাবে। একই সঙ্গে নদী তীরবর্তী মানুষ উপকৃত হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডে নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, হামকুড়া নদী আবার খনন করা হবে বলে তারা ষ্টাডি করেছেন। তিনি বলেন, পলি পড়ে নদীটা ভরাট হয়ে গেছে। পলির কারণে ২ বছর আগে ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে সালতা নদী খনন করলেও আবার ভরাট হয়ে গেছে। ফলে নদী খননের কোন সুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে না। এজন্য এবার নতুন ভাবে স্টাডি করে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে হামকুড়া, ভদ্রা ও সালতা নদীর পলি বন্ধ করার প্রকল্প রেখেই নদী খননের কাজ শুরু করা হবে।

This post has already been read 3435 times!

Check Also

চট্টগ্রামে পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষা, জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক প্রকল্প বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পের প্রসারে ফোরাম অন ইকোলজি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট গঠিত

চট্টগ্রাম সংবাদদাতা: দেশের পরিবেশ সংকটাপন্ন অন্যতম উপকুলীয় এলাকা চট্টগ্রাম বিভাগে পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষা, জীবাশ্ম …