ফকির শহিদুল ইসলাম (খুলনা) : বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে কৃষিজমিতে ফসল ফলানোর কথা ভুলতেই বসেছিলেন উপকূলীয় এলাকার কৃষকরা । কৃষি গবেষণা বিভাগ ও মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট লবণাক্ত মাটিতে বিভিন্ন ফষল উৎপাদনের জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করার ফলে পাল্টে গেছে লবণাক্ত এলাকার কৃষি উৎপাদনের চিত্র । দেশের দক্ষিণাঞ্চল মানেই যেন সারি সারি চিংড়ি ঘের। এই অঞ্চলের লবণাক্ত এলাকায় ফসল উৎপাদনের বিষয়টি একসময় কল্পনাও করা যেত না। আর এখন সেই উপকূলীয় এলাকার চাষিদের পতিত লবণাক্ত জমিতেই আবাদ করেছেন তরমুজ, ভুট্টাসহ নানা ফসল ও নানা ধরনের সবজি,সুর্যমুখি, বারেমাসী টমেটো,পাট,। শুধু পাটই নয় উপকূলীয় লবণাক্ত জমিতে বাদাম আবাদ করে ভালো ফলন পেয়েছেনকৃষকরা। তাঁরা দামও ভালো পেয়েছেন। এ জন্য বাদাম চাষে কৃষকদের মাঝে আগ্রহ বাড়ছে। বিভিন্ন জাতের ফষলের মাঠে বইছে সবুজের সমারোহ। এভাবে অনাবাদি জমিকে আনা হচ্ছে চাষাবাদের আওতায়। ভাগ্য বদলাচ্ছে কৃষকের। লবণসহিষ্ণু জাতের পাট ও বাদাম চাষ করা হয়। কৃষক পর্যায়ে বাদাম ও পাটের আবাদের এমন উদ্যোগ নেয়ায় কৃষকের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। কৃষকরা পেয়েছেন পাট ,বাদাম চাষে আশাতিরিক্ত সাফল্য। এখন কৃষকরা জমিকে পতিত না ফেলে বাদাম ও পাট চাষে হয়েছেন আশাবাদী। কিন্তু কীভাবে সম্ভব হচ্ছে লবণাক্ত জমিতে ফসল উৎপাদনের? আর কী পরিমাণ জমিই-বা আসছে চাষাবাদের আওতায়?
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, দেশে মোট ৮৪ লাখ হেক্টর অনাবাদি জমি রয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলেই রয়েছে প্রায় ২৫ লাখ হেক্টর জমি। এ জমির প্রায় অর্ধেকই লবণাক্ত। মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই)-এর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাটসহ ১৮টি জেলার ৯৩টি উপজেলায় লবণাক্ত জমির পরিমাণ ১০ লাখ ৫৬ হাজার হেক্টর, যা গত এক দশকের তুলনায় ২৩ হাজার হেক্টর বেড়েছে। আর ১৯৭৩ সালে লবণাক্ত জমির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর। এই হিসেবে ক্রমাগত লবণাক্ত জমির পরিমাণ বাড়ছে। কিন্তু লবণাক্ত জমিকেই এখন আনা হয়েছে চাষাবাদের আওতায়। উপকূলীয় বিস্তীর্ণ লবণাক্ত এলাকার বিশাল এই জমি এখন চাষাবাদের আওতায়। লবণাক্ত জমি চাষাবাদের উপযুক্ত হওয়ায় বেরেছে কৃষি উৎপাদন।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষির উন্নয়নে সরকার ১০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা নিয়েছে। ২০১৪ সালে নেওয়া এ পরিকল্পনায় অগ্রাধিকারভুক্ত খাত হিসেবে ফসল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, পুষ্টি, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, কৃষি বাণিজ্য, কৃষি ঋণ, কৃষি খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত জনশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৫৭ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা।
আর এই মহাপরিকল্পনায় পালটাতে শুরু করেছে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি উৎপাদনের চিত্র । কৃষি উৎপাদনের এই অবস্থা থেকে উত্তরণে গত ২০১১-১২ সালে এসআরডিআইয়ের লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণাকেন্দ্র গবেষণার মাধ্যমে বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে, যা গত কয়েক বছরে কৃষকের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে খামার পুকুর, কলস সেচ, দ্বিস্তরবিশিষ্ট মালচ, পলিব্যাগের চারা রোপণের মাধ্যমে তরমুজের চাষ, বপন বা রোপণের সময় পরিবর্তনের মাধ্যমে গম চাষ ইত্যাদি। ইতিমধ্যে গবেষণা কেন্দ্রের মাধ্যমে ঢ্যাঁড়শ, মিষ্টি কুমড়া, চিচিঙ্গা, ঝিঙা, শসা, বাঙ্গি, তরমুজের লবণ সহনশীল বিভিন্ন প্রকার জাত বাছাই করা হয়েছে। এসব প্রযুক্তি, বিশেষ করে খামার পুকুর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছোট পুকুরে জমিয়ে রেখে শুকনো মৌসুমে তরমুজের মতো উচ্চমূল্যের ফসল চাষাবাদ করা সম্ভব হচ্ছে। সম্ভব হচ্ছে ডিবলিং ও ট্রান্সপ্লান্ট পদ্ধতির মাধ্যমে ভুট্টা চাষ। এছাড়া লবণসহিষ্ণু জাতের ধান আবাদের পরিমাণ বাড়ছে।
ধান আর সবজি চাষ পালটে দিয়েছে খুলনার কৃষকের জীবনচিত্র। যে জলাবদ্ধতা আর লবণাক্ততা একসময় মানুষের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, খুলনার সেই বিলপাড়ের হাজারো মানুষের মুখে এখন সোনালি হাসির ঝিলিক। বিলগুলোতে এখন একদিকে যেমন মাছ ও ধান চাষ হচ্ছে, তেমনি হচ্ছে হরেক রকম সবজির চাষ। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আজ থেকে মাত্র কয়েক বছর আগেও খুলনা জেলার ডুমুরিয়া, ফুলতলা, রূপসা, দীঘলিয়া, তেরখাদা, দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার অধিকাংশ মানুষ ঘেরে মাছ চাষের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এসব মাছের ঘেরের পাড়ে কোনো ফসল চাষ করা হতো না। পতিত অবস্থায় পড়ে থাকত ঘেরের পাড়ের জমি। এখন মাছের ঘেরের পাড়ে চাষ হচ্ছে সবজি। অন্যান্য ফসলের তুলনায় লাভবান হওয়ায় কৃষকেরা ঘেরের পাড়ে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এখন ঘেরে মাছ চাষের পাশাপাশি দিনে দিনে ধান ও সবজি চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এসআরডিআই এর গোপালগঞ্জ-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা-পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের সহায়তায় খুলনা উপকূলীয় অঞ্চলের অনাবাদি ও পতিত জমিতে কৃষক বর্ষাকালীন আগাম জাতের টমেটো,তরমুজ ও শিম চাষে সাফল্য পেয়েছেন কৃষকরা। প্রকল্পের প্রশিক্ষণ, বিনামূল্যে কীটনাশক, সার, বীজ, মাচা তৈরির প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও নগদ অর্থ সহায়তার ফলে ঘুরতে শুরু করেছে উপকুল অঞ্চলের কৃষকদের অর্থনৈতিক ভাগ্যউন্নয়নের চাকা।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট (এসআরডিআই) এর খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও গোপালগঞ্জ-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা-পিরোজপুর কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, এতদিন লবণাক্ততার কারণে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে শুকনো মৌসুমে কৃষকেরা ফসল আবাদ করতে পারতেন না। কিন্তু এখন সুষম সার ও মাটি ব্যাবস্থাপনাসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পালটাতে শুরু করেছে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষি উৎপাদনের চিত্র । প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে লবণাক্ত জমিতেই বিভিন্ন জাতের ফসল চাষ সম্ভব হচ্ছে। তিনি বলেন, অনাবাদি এসব জমি এখন আবাদের আওতায় আসছে।
তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ইতিমধ্যে ৩-৪ লাখ হেক্টর অনাবাদি লবণাক্ত জমির ফসল চাষাবাদের আওতায় এসেছে। মাটির গুণমান উন্নয়নের কারণেই লবণাক্ত জমিতে ফসল হচ্ছে। একসময় আবাদ হতো না এমন অনেক জমি এখন চাষাবাদের আওতায় চলে এসেছে। তিনি বলেন, মাটি, পানি ও উদ্ভিদের নমুনা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সুষম সার ব্যবহার করে কীভাবে ফসল উৎপাদন করা যায়, সেই কাজই করছে এসআরডিআই। আমরা গবেষণার ফলাফলের ভিত্তিতে সুষম সার ব্যবহারের সুপারিশ করছি। তিনি বলেন, গবেষণার মাধ্যমে মাটির গুণমান বাড়ানো সম্ভব হলে ভবিষ্যতে কোনো জমিই চাষাবাদের বাইরে থাকবে না। বিভিন্ন উপজেলায় ঘেরের আইলেও প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকেরা সবজি আবাদ করছেন। চলতি ২০২১-২০২২ মৌসুমে শুধু ঘেরের আইলেই সবজি আবাদ হয়েছে ৭৫৬ হেক্টর জমিতে।