সাভার সংবাদদাতা: মাছ, মাংস, ডিম উৎপাদনে বাংলাদেশ ইতোঃমধ্যেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে, দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতার কাছাকাছি। প্রাণিসম্পদ খাত আমাদের বার্ষিক জিডিপিতে বড় ভূমিকা রাখছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময় ও বর্তমান সময়ে যদি আমরা মাথাপিছু দুধ, ডিম ও মাংসের প্রাপ্যতা বিবেচনা করি তবে আমরা সহজেই বুঝতে পারবো এই খাতে কতটা অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এই অগ্রগতির পিছনে গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে বিএলআরআই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছে। তবে কেবল উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, বরং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষ উৎপাদনের দিকেও আমাদের গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
মঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) কর্তৃক ২০২১-২০২২ অর্থবছরে সমাপ্ত গবেষণাসমূহের ফলাফল ও অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ গবেষণা পরিকল্পনা গ্রহণের লক্ষ্যে ‘বার্ষিক রিসার্চ রিভিউ কর্মশালা ও প্রযুক্তি হস্তান্তর-২০২২’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান উদ্বোধনকালে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, এমপি এসব কথা বলেন।
বিএলআরআই এর মূল কেন্দ্র সাভারে দুই দিনব্যাপী ‘বার্ষিক রিসার্চ রিভিউ কর্মশালা ও প্রযুক্তি হস্তান্তর-২০২২’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথি হিসেবে দুই দিনব্যাপী এই কর্মশালাটির উদ্বোধন করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এমপি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ এবং সম্মানীয় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রাণিসম্পদ-২) এটিএম মোস্তফা কামাল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন।
বিশেষ অতিথি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. নাহিদ রশীদ বলেন, বিএলআরআই এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে কাজ করার মধ্য দিয়ে জাতির জন্য ভূমিকা পালন করার সুযোগ আছে, গবেষণার সুযোগ আছে। আমাদের যা আছে, যতটুকু বিজ্ঞান আছে, যতটুকু প্রজ্ঞা আছে, সেটুকু নিয়েই কাজ করতে হবে। সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে প্রযুক্তি যাতে সঠিকভাবে মাঠপর্যায়ে সম্প্রসারণ করা সম্ভব হয়, সেই চেষ্টা করতে হবে। ছোট ছোট কাজগুলো আরেকটু আন্তরিকতার সাথে করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে বিএলআরআই-এর মহাপরিচালক ড. এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম তুলে ধরে বলেন, বিএলআরআই বিএলআরআই বর্তমান সরকারের ভিশন ও মিশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। একই সাথে উন্নত বাংলাদেশ হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় লক্ষ্যমাত্রা পূরণের লক্ষ্যে নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধিতেও বিএলআরআই কাজ করে চলেছে। আরসিসিকে জাত হিসেবে অচিরেই ঘোষণা করা হবে। আগামী বছরের মধ্যেই মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের দুইটি ভ্যারাইটি পালনের কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। প্রাণিরোগ দমনে সাধারণ কৃষকের চাহিদা পূরণে এলএসডি ভ্যাকসিনসহ বিভিন্ন ভ্যাকসিন উৎপাদনের লক্ষ্যেও বিএলআরআই কাজ করে চলেছে। কৃত্রিম প্রজননের প্রক্রিয়া সহজ করার লক্ষ্যে এমন প্রযুক্তি উৎপাদন করা হচ্ছে যা কম খরচে ও খুব সহজে ভ্রাম্যমান পদ্ধতিতে ফ্রোজেন সিমেন সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে।
এর আগে সকাল সাড়ে ১০ টায় পবিত্র কোরআন হতে তেলোয়াত এবং পবিত্র গীতা পাঠের মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি শুরু হয়। এর পর আমন্ত্রিত অতিথিদের উদ্দেশ্যে স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন এবং কর্মশালার সার সংক্ষেপ তুলে ধরেন বিএলআরআই এর মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পরিচালক (গবেষণা) ড. নাসরিন সুলতানা।
স্বাগত বক্তব্য প্রদানের পরে বিএলআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত বিএলআরআই মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ) এবং বিএলআরই ঘাস-৫ (লবণ সহিষ্ণু) প্রযুক্তি দুটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদার নিকট হস্তান্তর করেন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. এস এম জাহাঙ্গীর হোসেন।
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিএলআরআই তার জন্মলগ্ন থেকেই দেশের প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছে। দেশের প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে জাতীয় চাহিদার নিরীখে গবেষণা পরিচালনা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, প্রাণিসম্পদের উৎপাদন সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের অভিলক্ষ্য নিয়ে বিএলআরআই কাজ করে চলেছে। বিএলআরআই এর প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সময় থেকে অদ্যাবধি মোট ৯৩টি প্যাকেজ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে, যা বিভিন্ন সময় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান এবং উদ্যোক্তাদের মাঝে হস্তান্তর করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বার্ষিক রিসার্চ রিভিউ কর্মশালা ও প্রযুক্তি হস্তান্তর-২০২২ অনুষ্ঠানে বিএলআরআই কর্তৃক উদ্ভাবিত বিএলআরই মিট চিকেন-১ (সুবর্ণ) এবং বিএলআরই ঘাস-৫ (লবণ সহিষ্ণু) জাত দুটি প্রযুক্তি আকারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়।
উক্ত আয়োজনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন বিএলআরআই-এর সাবেক মহাপরিচালকগণ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হতে আগত শিক্ষকবৃন্দ, প্রাণী ও পোল্ট্রি উৎপাদন ও খামার ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত বিশেষজ্ঞ এবং সংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ, বিএলআরআই-এর বিভিন্ন পর্যায়ের বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তাবৃন্দ এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম হতে আগত প্রতিনিধিবৃন্দ।
উদ্বাধনী অনুষ্ঠানের পরে শুরু হয় কারিগরি সেশন। এবারের কর্মশালায় পাঁচটি সেশনে সর্বমোট ৩০ (ত্রিশ) টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হবে। এর মধ্যে প্রথম দিনে “অ্যানিম্যাল অ্যান্ড পোল্ট্রি ব্রিডিং অ্যান্ড জেনেটিকস” শীর্ষক প্রথম সেশনে ০৮ (আট) টি, “বায়োটেকনোলজি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স” শীর্ষক দ্বিতীয় সেশনে ০৬ (ছয়) টি এবং সোশিওইকোনোমিকস অ্যান্ড ফার্মিং সিস্টেম রিসার্চ” শীর্ষক তৃতীয় সেশনে ০৪ (চার) টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হবে। কর্মশালার দ্বিতীয় দিনে “অ্যানিম্যাল অ্যান্ড পোল্ট্রি ডিজিজ অ্যান্ড হেলথ” শীর্ষক চতুর্থ সেশনে ০৭ (সাত) টি এবং “ফিডস, ফডার অ্যান্ড নিউট্রিশন” শীর্ষক পঞ্চম সেশনে ০৫ (পাঁচ) টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। প্রবন্ধ উপস্থাপনার পাশাপাশি কর্মশালায় বিভিন্ন গবেষণার উপর মোট ৪২ (বিয়াল্লিশ) টি পোস্টারও প্রদর্শন করা হয়।