সোমবার , ডিসেম্বর ৩০ ২০২৪

সাসটেইনেবল ফিড কোয়ালিটি ও আমাদের ভবিষ্যৎ

রেজাউল কবির: কোয়ালিটি সম্পন্ন খাদ্য উৎপাদনে প্রথমত প্রয়োজন– দেশ ও জাতিকে কিছু দেয়ার জন্য সুস্থ্য চিন্তা-ভাবনা। দ্বিতীয়ত প্রয়োজন- কোয়ালিটি সম্পন্ন কাচামাল ও এডিটিভস। কোয়ালিটি সম্পন্ন বললাম কারন- প্রাণীর GIT রক্ষায় কোয়ালিটি সম্পন্ন কাচামালের কোন বিকল্প নেই। যদি আরও একটু ক্লিয়ার করে বলি তাহলে বলতে হবে- Gut-এর পরিবেশ ভাল থাকলে প্রাণীর সুস্থ্যতা নিশ্চিতের পাশাপাশি ইনটেসটাইনাল বেরিয়ার কম থাকে ও Gut function সঠিক ভাবে কাজ করে। ফলে অন্ত্রের ভিলাই-এর বৃদ্ধির পাশাপাশি যথাযথ এনজাইম সিক্রেশন অবস্থা তৈরী হয় এবং পুষ্টি উপাদানের সর্বোচ্চ শোষণ নিশ্চিত করা যায়। এতগুলো কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই- ভাল কিছু পেতে হলে ভাল কিছু দিতে হবে। এবার আসুন মূল কথায় যাই।

প্রথমেই বলেছিলাম- সুস্থ্য চিন্তাভাবনার কথা। একথা দ্বারা যে বিষয়টি বুঝাতে চাচ্ছি, তা হল – ”ক্ষতিকর গ্রোথ প্রোমোটার মুক্ত খাদ্যপণ্য উৎপাদন হোক সবার লক্ষ্য” এই স্লোগানকে মিশন ও ভিশন করে সকলকে (ফিডমিল মালিক, পুষ্টিবিদ ও এডিটিভস ইমপোর্টার) একসাথে কাজ করা।

এ অবস্থা তৈরি করতে কিছু সমস্যা আছে। যেমন ধরুন- ফিড উৎপাদক, এডিটিবস ও বিপণন কাজের সাথে জড়িত গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তির সঠিক চিন্তার অভাবে সামগ্রিক ভাবে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স জনিত সমস্যার সমাধানে আশু ফল পাওয়া যাচ্ছে না। টাকা আয়ের উৎস হিসেবে আপনি যে পেশাই (ব্যবসা, চাকুরী) গ্রহণ করেন না কেন দেশের প্রতি ডেডিকেশান না থাকলে অতি আয়ের অসুস্থ নেশা থেকে বের হয়ে দেশকে ভাল কিছু দেয়া পসিবল না।

তবে একটি কথা বলতে চাই- আপনি, তারা এবং আমরা সবাই যেভাবে খুব কম সময়ে অতি উন্নতির আশায় অসুস্থ্য পন্থা অবলম্বন করছি বা করতে চাই তাতে বর্তমান রেজিস্ট্যান্স অবস্থার বিভিন্ন রিপোর্ট দেখলেই বুঝা যায়- বর্তমানে আমরা কতটা বিপদের মুখোমুখি । পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য যে এ অবস্থা আরও কঠিন হবে তা বর্তমান রিপোর্টগুলো দেখলেই আশংকা করা যায়। আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সু্স্থ্যতার কথা বিবেচনায় রেখে আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজের বিবেককে কাজে লাগানো। আমাদের শপথ হওয়া উচিত- ”ক্ষতিকর গ্রোথ প্রোমোটার ব্যবহার করব না, দেশের ক্ষতি করব না”

দ্বিতীয় পয়েন্টটির কথা মনে আছে কি? তা হল কোয়ালিটি সম্পন্ন কাচামাল। কোয়ালিটি সম্পন্ন কাচামাল বলতে আমি বুঝি- যে সব কাচামাল প্রপার প্রসেসের মাধ্যমে তার নিজস্ব ধর্ম, বর্ণ, গন্ধ, পুষ্টিগুণ অক্ষুন্ন রেখে উৎপাদিত, ভেজালমুক্ত, জীবাণুমুক্ত (ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, রিকেটসিয়া, মাইকোপ্লাজমা অ্যাকটিনোমাইসিটিস, প্রোটোজোয়া, নেমাটোড ইত্যাদি) ও জীবাণুমুক্ত পরিবেশে সংরক্ষিত এবং যাদের অক্সিডেশন, ফাংগাস ও টক্সিন মাত্রা অনুমোদিত স্ট্যান্ডার্ড পর্যায়ে থাকে সেই সব কাচামালকে কোয়ালিটি সম্পন্ন কাচামাল বলে। অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে নিম্নমানের কাচামাল দিয়ে উৎপাদিত খাদ্যের ব্যবহারে প্রাণীর বিভিন্ন প্রবলেম হতে পারে। যেমন- খাদ্যের ডাইজেস্ট পারসেন্ট কমে যাবে যা প্রাণীর Feed Passage Syndrome-র একটি কারন হতে পারে। সাধারণত ফিডের পি.এইচ বেশী হলে, নিম্নমানের বা Rotten Fat ব্যবহারে, Antinutritional Factor, Eimeria, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিভিন্ন প্রজাতির উপস্থিতি, Burnt Soyabean ইত্যাদি Feed Passage Syndrome তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে।

যাই হোক বাংলাদেশের আবহাওয়া খাদ্যশস্যে ছত্রাক বা মোল্ড আক্রমনের হার বাড়াতে উপযোগী। শস্যের আর্দ্রতা স্ট্যান্ডার্ডের অতিরিক্ত ধারণের কারনে গোডাউন জাত করনের পর অল্প সময়ের ব্যবধানেই শস্য ফাংগাস বা মোল্ডে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। ফলশ্রুতিতে খাদ্যে টক্সিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। যেহেতু প্রকৃতিতে পর্যাপ্ত পরিমান মোল্ড বিদ্যমান যা খাদ্যদব্যে বিভিন্ন টক্সিন নিঃসরণ করে খাদ্যশস্য নষ্টের পাশাপাশি প্রাণীর ক্ষতি সাধন করে থাকে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য মোল্ড বা টক্সিনে আক্রান্ত হয়ে খাদ্য শিকলের মাধ্যমে তা বাহিত হয়ে মানবদেহে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি করে থাকে। এর ফলে আর্থিকভাবে ও স্বাস্থ্যগত ভাবে আমরা ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছি। এজন্য শস্য সংরক্ষণে সচেতনতার পাশাপাশি আপডেট টেকনলজি নিয়ে উদ্যোক্তাদের কাজ করা উচিত। প্রয়োজনে শস্য সংরক্ষনের সময় তা Fungistat ব্যবহার করা। অন্যথায় মোল্ড ও টক্সিনের কন্ট্রোল করা খুব কষ্টসাধ্য।

এক গবেষণায় দেখা যায়, ভূট্টায় ছত্রাকের মোল্ডের কারনে এর পুষ্টিমানের যথেষ্ট হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে যা নিচের টেবিলে দেখানো হল-

Parameter Good Corn Moldy Corn Reduction %
Total Fat % 3.8 2.4 36.8
Fatty Acid Content Palmitic (16:0) 11.3 9.1 19.5
Metabolizable Energy (kcal/kg) 3350 2510 25.1
Carotene (mg/kg) 3.1 2.3 25.8
Table: Mold growth decrease the nutritional value of corn
(Ref: Hy-line company technical update)

উপরোক্ত কম্পেয়ার টেবিল থেকে ফাংগাসের নেতিবাচকতার যে প্রমাণ মেলে, তারপর এর সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই বলে আমি মনে করি।

টক্সিন হল একপ্রকার বিষাক্ত (Poisonous) পদার্থ (অণু/পেপটাইড/প্রোটিন) যা উদ্ভিদ, প্রাণী বা অন্যান্য জীব (ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া ভাইরাস, প্রোটোজোয়া ইত্যাদি) দ্বারা উত্পাদিত হয়। অর্থাৎ,Toxin হল উদ্ভিদ বা প্র্রাণীর উৎসের একটি বিষ যা বিশেষ করে অণুজীব থেকে উৎপাদিত হয়। Toxin শরীরে কম ঘনত্বে উৎপাদিত হলে বিভিন্ন রোগের সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানে, একটি Toxin-কে প্রায়শই একটি নির্দিষ্ট ধরণের বিষ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। প্রকৃতিতে এমন অনেক ধরণের ব্যাকটেরিয়া আছে যারা খাবারে সংখ্যাবৃদ্ধির সময় টক্সিন নামক বিষ নির্গত করে। টক্সিন তখনই জীবের ক্ষতি করবে যখন তা কোন জীবের টিস্যুর সংস্পর্শে আসবে বা শোষিত হবে।

আর বিভিন্ন টক্সিনের মধ্যে মাইকোটক্সিন হ’ল ছত্রাকের বিপাকের ফলে উৎপন্ন বিষাক্ত পদার্থ যা প্রাণীর খাদ্যে উৎপন্ন হতে পারে। ফলে খাদ্যে মাইকোটক্সিন দূষণের ফলে খামারে বিভিন্ন প্রভাব পড়তে পারে যা অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ ও ঝুঁকি তৈরি হয়। যেমন- উৎপাদন হ্রাস, রোগ-প্রতিরোধ ও প্রজনন ক্ষমতা কমে যাওয়া এবং মৃত্যুহার বৃদ্ধির পাশাপাশি কন্টামিনেটেড ফিড সদ্ব্যবহার কমতে থাকে।

মাইকোটক্সিন খাদ্যের মাধ্যমে গ্রহণের ফলে প্রানীর স্বাস্থ্যের উপর যেমন ঝুঁকি ফেলে তেমনি বৃহত্তর অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। নিম্নে বিভিন্ন প্রকার মাইকোটক্সিনের নাম, উৎপাদক ও তাদের প্রভাব দেয়া হল:

Type Fungus Affects
Aflatoxin Aspergillus flavous;
A. parasiticus;
A. nomius;
A. pseudotamarii.
Liver damage (Hepatoxic),
Immuno-Suppression,
Carcinogenic,
T-2 Toxins Fusarium Oral & Dermal Lesions, Mucosal Damage.
Deoxynivalenol
or Vomitoxin
(DON)
Fusarium Neurological disorder.
Liver damage.
Dermatoxic.
Ochratoxin Penicillium &
Aspergillus
Kidney damage (Nephrotoxic)
Fumonisins  

Fusarium

Diarrhea, Reduced productivity, Liver Damage,
Immuno-suppression.
Zearalenones Fusarium Reproductive Disorders

ব্যাকটেরিয়া কর্তৃক উৎপাদিত টক্সিনকে Exotoxin ও Endotoxin বলে। তন্মধ্যে গ্রাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা উৎপাদিত টক্সিনকে Exotoxin বলা হয়। গ্রাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া: Staphylococcus, Enterococcus, Streptococcus, Actinomyces, Clostridium ইত্যাদি এবং গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া দ্বারা উৎপাদিত টক্সিনকে Endotoxin বলা হয়। গ্রাম নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া: E. coli, Salmonella, Pseudomonas, Shigella ইত্যাদি।

উৎপাদিত খাদ্যে মোল্ডের সংক্রমণ কমাতে মোল্ডকে বাইন্ড করতে গ্রেড অনুযায়ী যেমন মোল্ড ইনহিবিটর ব্যবহার করা হয়। সেই সাথে উৎপন্নকৃত মোল্ড থেকে যে টক্সিন নিঃসৃত হয় তাকে বাইন্ড করার জন্য টক্সিন বাইন্ডার ব্যবহৃত হয়। এখন আমরা টক্সিন বাইন্ডার সম্পর্কে কিছু ধারণা নিব। বাজারে বিভিন্ন ধরণের টক্সিন বাইন্ডার পাওয়া যায়। যেমন-

(ক) Silicate Products: Phyllosilicates.  যেমন: Montmorillonite, Bentonite, Hydrated Sodium, Calcium Aluminosilicate ইত্যাদি। এরা আফলাটক্সিনকে বাইন্ড করতে সক্ষম।

(খ) Inorganic Polymers: Cholestyramine, Polyvinylpyrrolidone (PVP). এরা Aflatoxin, Zearalenones, Fumonisins-কে বাইন্ড করে।

(গ) Organic Polymers:

Alfalfa fiber- এরা Zearalenone-র ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস করে।

Saccharomyces- Live yeast আফলাটক্সিনের ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস করে।

Strains of lactic acid, Propionibacterium & Bifidobacteria: এরা মাইকোটক্সিন (Aflatoxin এবং কিছু Fusarium) বাইন্ড করে।

Esterified glucomannan polymer- এটি Aflatoxin, Ochratoxin T-2 Toxin বাইন্ড করে।

(ঘ) Carbon Products: Charcoal. এটি সুপার এ্যাক্টিভেটেড টক্সিন বাইন্ডার এবং পুনরায় টক্সিফিকেশন রোধ করতে খুবই কার্যকরী।

গুণগত মানসম্মত মাছ, মাংস, ডিম ও দুধ উৎপাদন  এবং কনজিউমের মাধ্যমেই আমরা নিজেদেরকে সুস্থ্য রাখার পাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ্য, সুন্দর ও মেধাবী জাতিতে পরিনত করতে পারি। আমিষ উৎপাদনে ব্যবহৃত কাচামালের সঠিক গুণগত মান যদি ধরে রাখা না যায় তাহলে ভাল কিছু আশা করা বোকামীর সামিল। তাই দেশে উৎপাদিত শস্য বা বাইপ্রোডাক্টস ও আমদানীকৃত কাচামালের সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতি আরও জোরদার করার পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা  চালানো প্রয়োজন। প্রজাতির উপর ভিত্তি করে মাইকোটক্সিন বাইন্ডার ব্যবহারে যথেষ্ট মনযোগী হওয়া উচিত। তাছাড়া জীবাণুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক বায়োটিক ব্যবহারে মনযোগী  হওয়া (গ্রোথের জন্য নয়), ইউবায়োটিকের (প্রি/প্রো/পোস্ট বায়োটিক, এনজাইম ও অর্গানিক এসিড ইত্যাদি) সঠিক ব্যবহার ইত্যাদি কাজে মনযোগী হলে দেশ ও জাতি বিভিন্ন দূরারোগ্য ব্যাধি এবং এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স থেকে মুক্তি পাবে বলে আশা করা যায়। তাই সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যকর উৎপাদন পেতে স্বাস্থ্যকর কাচামালের অন্বেষণ, উৎপাদন, আমদানী, সংরক্ষন ও সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমেই স্বাস্থ্যকর খাবার উৎপাদনের মাধ্যমে সুস্থ্য খাদ্য শৃঙ্খলের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সম্ভব। ফলে দেশ তথা পৃথিবী পাবে- শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ্য জাতি।

লেখক: ফ্যাক্টরি ম্যানেজার, বন্ধু ফিড (একটি আব্দুল মোনেম গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান)।

This post has already been read 4216 times!

Check Also

ডিম ও মুরগির বাজার স্থিতিশীলতায় দরকার  “জাতীয় পোল্ট্রি বোর্ড” গঠন

কৃষিবিদ অঞ্জন মজুমদার : পোল্ট্রি শিল্পের সাথে আন্ত:মন্ত্রনালয়, আন্ত:অধিদপ্তর  এবং উৎপাদন ও বিপননে ডজনের উপরে …