ড. মো. মাহফুজ আলম: বাংলাদেশে ধান প্রধান ফসল হিসেবে পরিচিত এবং এর উৎপাদন গ্রামীণ অর্থনীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলে। তবে, বিভিন্ন পোকামাকড়ের আক্রমণ ধানের উৎপাদন ও গুণগত মানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যার মধ্যে “ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার” (Brown Plant Hoppe-BPH) অন্যতম। BPH ধান উৎপাদনে অন্যতম ধ্বংসাত্মক পোকা, বিশেষত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, যেখানে ধান প্রধান খাদ্য শস্য। বাংলাদেশ, একটি প্রধান ধান উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে, BPH আক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে এর উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে, যা এই পোকার বৃদ্ধি ও বংশবৃদ্ধির জন্য অনুকূল।
বাংলাদেশে আমন মৌসুমে ধানের অন্যতম প্রধান ক্ষতিকর পোকা হলো ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার (BPH)। এই পোকা গাছের কাণ্ডে বসে রস শোষণ করে, যার ফলে ধানগাছ দুর্বল হয়ে পড়ে, পাতা হলদে হয়ে শুকিয়ে যায় এবং ফলন কমিয়ে দেয়। এর আক্রমণে ধানক্ষেতে হপারবার্ন নামে পরিচিত ক্ষতির সৃষ্টি হয়, যেখানে গাছ পুরোপুরি মরে যায় এবং ফলন কমে যায়।
ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপ-গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের ধানক্ষেতে দেখা যায়, এবং অনুকূল আবহাওয়া ও উচ্চ সারের ব্যবহার এদের বিস্তারকে ত্বরান্বিত করে। এই কারণে আমন মৌসুমে ধানের ফলন সুরক্ষিত রাখতে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রায় সতেরো কোটি মানুষের খাদ্য হিসেবে ধানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিবেচনায়, ধানের ফসল সুরক্ষায় কার্যকর নিয়ন্ত্রণ কৌশল গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার (Nilaparvata lugens), যা সাধারণত BPH নামে পরিচিত, একটি মারাত্মক ক্ষতিকর পোকা যা ধান উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি করে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে, বিশেষত বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইনে এটি ধানের অন্যতম প্রধান শত্রু হিসেবে বিবেচিত। ধান এ অঞ্চলের প্রধান খাদ্যশস্য হওয়ায় BPH এর আক্রমণ খাদ্য উৎপাদনে গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে এবং ফসলের ক্ষতির কারণে খাদ্য নিরাপত্তায় সংকট দেখা দিতে পারে।
ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার ছোট আকারের বাদামী রঙের একটি পোকা। পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় এদের দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩-৪ মিমি এবং এরা সাধারণত ডানাওয়ালা বা নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে ডানাবিহীন হতে পারে। এদের জীবনচক্রের তিনটি প্রধান ধাপ রয়েছে: ডিম, নিম্ফ এবং পূর্ণবয়স্ক। একবারে একটি পূর্ণবয়স্ক মাদি পোকা ২০০ থেকে ৩০০টি ডিম পাড়তে সক্ষম, যা গাছের কাণ্ড বা পাতার নিচে পাতা হয়। ডিম ফুটে নিম্ফ বের হয় এবং তারা ধান গাছে বসবাস করে। নিম্ফ অবস্থা থেকে পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় পরিণত হতে প্রায় ২-৩ সপ্তাহ সময় লাগে এবং প্রতিকূল আবহাওয়া এবং খাদ্যের প্রাচুর্যের কারণে এরা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে পারে।
ব্রাউন প্ল্যান্ট হপারের আক্রমণ ও ক্ষতির প্রকৃতি
১. শোষণ প্রক্রিয়া: ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার গাছের পাতা এবং কান্ডের রস শোষণ করে। এর ফলে গাছের পানি ও পুষ্টি ধারণ ক্ষমতা হ্রাস পায়, গাছ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শুকিয়ে যায়। এই অবস্থাকে “হপার বার্ন” বলা হয়, যা ধানের পুরো ক্ষেতকে শুকিয়ে ফেলতে পারে ।
২. ভাইরাস সংক্রমণ: ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার Grassy Stunt Virus এবং Ragged Stunt Virus ভাইরাসের বাহক হিসেবে কাজ করে। এটি ধানের Grassy Stunt Virus এবং Ragged Stunt Virus রোগ ছড়ায়, যা গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত করে।
৩. ফসলের ক্ষতি ও আর্থিক ক্ষতি: ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার (BPH) এর মারাত্মক আক্রমণ কুশি থেকে শিষ গঠনের পর্যায়ে ফসলের উৎপাদনশীলতা ৮০-১০০% পর্যন্ত কমাতে পারে। এটি বিশেষত বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে আমন ধান প্রধান খাদ্যশস্য এবং বাৎসরিক ধান উৎপাদনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। বাংলাদেশে BPH এর প্রাদুর্ভাব ধান উৎপাদনে ভয়াবহ ক্ষতি সৃষ্টি করতে পারে, যা কৃষকদের আয়কে সরাসরি প্রভাবিত করে এবং দেশের খাদ্য সংকটের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। ২০২৪ সালে BPH এর কারণে উৎপাদনশীলতার এই হ্রাস লক্ষ ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হতে পারে, যা বিশেষত ছোট কৃষকদের।
৪. জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি: ধান বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশস্য এবং BPH এর কারণে ব্যাপক ফসলহানি জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ। ২০২৪ সালে BPH এর প্রাদুর্ভাব তীব্র হওয়ায় ধানের সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় দাম বৃদ্ধি পেতে পারে, যা নিম্ন আয়ের ভোক্তাদের জন্য ক্রয়ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। পাশাপাশি, BPH এর প্রাদুর্ভাব খাদ্য সরবরাহে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, যা বাংলাদেশের আমদানিকৃত ধানের উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে তোলে।
দমন ব্যবস্থাপনা
১. মনিটরিং: BPH এর প্রাথমিক সনাক্তকরণ এবং ফসলের ক্ষতি কমানোর জন্য নিয়মিত পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। বীজতলা বা মাঠে প্রতিদিন বা সাপ্তাহিক পর্যবেক্ষণ এবং কাণ্ড ও পানির পৃষ্ঠ পরিদর্শন করার পরামর্শ দেওয়া হয়। পুরোনো গাছগুলিকে টোকা দেওয়ার মতো বিভিন্ন পদ্ধতি সনাক্তকরণে সহায়ক। দুধ আসা পর্যন্ত ফসলের জন্য BPH বা হোয়াইট-ব্যাকড প্ল্যান্ট হপার অনুসন্ধান করতে হবে।
২. পরিচর্যা: শস্যাবর্তন বা ধান চাষের পরিবর্তে কিছু সময় অন্য ফসল চাষ করা যেতে পারে, যা ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার এর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে। ক্ষেত পরিচ্ছন্ন রাখা: ক্ষেতের আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করা প্রয়োজন যাতে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপারের আবাসস্থল কমে যায়।
৩. যান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ: হ্যান্ড পিকিং তথা ছোট পরিসরে হপার গুলোকে হাত দিয়ে তুলে ধরা বা ধ্বংস করা সম্ভব। আক্রমণ প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে আলোক ফাঁদ স্থাপন করে পোকা আকৃষ্ট করা এবং ধ্বংস করা সম্ভব।
৪. জৈবিক নিয়ন্ত্রণ: ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার এর প্রাকৃতিক শত্রু যেমন মিরিড বাগ, মাকড়সা এবং ডিম প্যারাসিটয়েড ইত্যাদি ধান ক্ষেতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে, যারা হপার খেয়ে ফেলতে সক্ষম। ছত্রাক যেমন Beauveria bassiana এবং Metarhizium anisopliae ব্যবহার করে হপার নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
৪. কীটনাশক ব্যবহার: ক্ষেত্রবিশেষে অনুমোদিত কীটনাশক (ডাইমেথোয়েট ৬০ইসি ১ লিটার/হেক্টর, ডায়াজিনন ৬০ইসি ১ লিটার/হেক্টর, ইমামেকটিন বেনজয়েট ৫এসজি ১ কেজি/হেক্টর) প্রয়োগ করে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব (চিত্র ৪.)। তবে কীটনাশক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে, যেন পরিবেশ ও অন্যান্য উপকারী প্রাণীর উপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
৫. সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা: এটি একটি সামগ্রিক পদ্ধতি যেখানে পরিচর্যা, যান্ত্রিক, জৈবিক ও রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে ধান ক্ষেতের পরিবেশ উপযোগী করে তোলা হয়, যাতে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার সহ অন্যান্য ক্ষতিকর পোকামাকড়ের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
২০২৪ সালে ব্রাউন প্ল্যান্ট হপার (BPH) বাংলাদেশে আমন ধান উৎপাদনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হুমকি হিসেবে অব্যাহত রয়েছে, যা সরাসরি এবং পরোক্ষ ক্ষতির মাধ্যমে ফলন ও গুণমানে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। কীটনাশকের প্রতিরোধ ক্ষমতা, পরিবেশগত উদ্বেগ এবং খাদ্য নিরাপত্তার কারণে টেকসই BPH ব্যবস্থাপনার কৌশল গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার (IPM) পদ্ধতি, যা পর্যবেক্ষণ, পরিচর্যা পদ্ধতি, রাসায়নিক এবং জৈবিক নিয়ন্ত্রণ অন্তর্ভুক্ত করে, দীর্ঘমেয়াদে BPH এর ক্ষতি হ্রাস এবং বাংলাদেশের ধান উৎপাদন সুরক্ষায় আরও কার্যকর সমাধান প্রদান করতে পারে।
লেখক: গবেষক ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা (শস্য), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), ঢাকা।