গাজীপুর সংবাদদাতা: প্রচলিত দ্বি-ফসলি শস্যবিন্যাসে তেল জাতীয় ফসল (সরিষা, সূর্যমুখী) অর্ন্তভূক্ত করার মাধ্যমে কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাইস ফার্মিং সিস্টেমস্ বিভাগ। দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের বিদ্যমান সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করে থাকে রাইস ফার্মিং সিস্টেমস্ বিভাগের বিজ্ঞানীরা। বিভাগের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ফার্মিং সিস্টেম সাইট, কালীগঞ্জ, গাজীপুরে স্থানীয় ১০ জন প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের বসতবাড়িতে বছরব্যাপী সবজি চাষ, ছায়াযুক্ত স্থানে আদা-হলুদ চাষ, ফল গাছের ব্যবস্থাপনা, হাঁস-মুরগি, কবুতর ও ছাগল পালন এবং মজা পুকুরে কচুর সাথে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এসব কাজে নারীদের সক্রিয় অংশগহণের পাশাপাশি তাদের ছেলে-মেয়েরা অবসর সময়ে অংশগ্রহণ করে দৈনন্দিন সবজি ও আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি কৃষকেরা বাড়তি আয় করছেন। রাইস ফার্মিং সিস্টেমস্ বিভাগের গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় একজন কৃষক তার ১০ শতাংশ বসতবাড়ির ৯.৫ শতাংশ জমিতে বছরব্যাপী সবজি চাষের মাধ্যমে ২,০০০ টাকা খরচ করে ৬,০০০ টাকা লাভ করেছেন।
আজ (৫ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলার সাওরাইদ গ্রামে সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষকের জীবনমান উন্নয়ন বিষয়ক এক মতবিনিময় সভা ও মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানে স্থানীয় শতাধিক কৃষক অংশ নেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড. মসিউর রহমান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, গাজীপুর এর উপ-পরিচালক কৃষিবিদ রফিকুল ইসলাম খান প্রমূখ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাইস ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. ইব্রাহিম। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খায়রুল কায়েস, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবিএম জামিউল ইসলাম প্রমুখ। বক্তব্য রাখেন সূর্যমুখী চাষী লিটন ও সরিষা চাষী মো. আবুল বাশার।
প্রধান অতিথি ব্রি’র মহাপরিচালক ড. মোহাম্মদ খালেকুজ্জামানতার বক্তব্য বলেন, কৃষিকে লাভবান করতে হলে কোনো জমিকে বছরের কোন সময়ই অনাবাদি রাখা যাবে না। আমন ও বোরো মওসুমের মাঝে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা অনাবাদি রয়ে যায়। এই অনাবাদি জমিকে রবি মওসুমে সরিষা, সূর্যমুখীসহ বিভিন্ন শীতকালীন ফসল চাষের আওতায় আনতে হবে। বোরো-পতিত-রোপা আমন, শস্য বিন্যাসে সরিষা/সূর্যমুখী অন্তভুক্তি করতে পারলে সমগ্র দেশে ৩.৬০ মিলিয়ন টন তেল ফসল উৎপাদন সম্ভব। যা থেকে বছরে ১.০৪ মিলিয়ন টন তেল পাওয়া যেতে পারে। তিনি জানান, কালীগঞ্জে বোরো-পতিত-রোপা আমন, শস্যবিন্যাস প্রায় সাড়ে ২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা হয়। এ শস্যবিন্যাসের উন্নয়নের জন্য প্রথমত বোরো এবং রোপা আমন ধানের মধ্যবর্তী সময়ে তেল জাতীয় ফসল (সরিষা, সূর্যমুখী) চাষ করে কৃষক লাভবান হতে পারে। সরিষা/সূর্যমুখী কেন যুক্ত করা হলো এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভোজ্য তেলের জন্য আমরা পরনির্ভশীল। প্রতি বছর প্রায় ২.৩ থেকে ২.৪ মিলিয়ন টন ভোজ্য তেল আমাদের আমদানি করতে হয়। এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। এ উদ্দ্যেশ্যকে সামনে রেখে কালীগঞ্জ উপজেলায় বিদ্যমান বোরো-পতিত-রোপা আমন শস্যবিন্যাসে স্বল্প জীবনকাল সম্পন্ন বারি সরিষা-১৪ এবং বারি সূর্যমুখী-৩ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বোরো ও আমন মওসুমে চাষাবাদকৃত প্রচলিত জাতসমূহ সম্প্রতি উদ্ভাবিত অধিক ফলনশীল জাত দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হচ্ছে। অধিকিন্তু আধুনিক ধান ও শস্যবিন্যাস ব্যবস্থাপনার উপর প্রশিক্ষণ প্রদানের ফলে কৃষক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সর্ম্পকে সম্যক ধারনা পাচ্ছে। এতে করে বিভিন্ন ইকোসিস্টেমে ধানের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাইস ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগের প্রধান ড. মো. ইব্রাহিম জানান, আগে কৃষকেরা গড়ে ৫০ কেজি সবজি ভক্ষণ করতো, ৫ কেজি বিলি করতো এবং ৪০ কেজি বিক্রি করতো; যা বর্তমানে এই কার্যক্রমের মাধ্যমে বেড়ে ১১১, ১২ এবং ৫৮ কেজিতে পৌঁছেছে । বসতবাড়ির ০.৫ শতাংশ ছায়াযুক্ত স্থানে আদা-হলুদ চাষ করে কৃষকেরা গড়ে ৮২ কেজি হলুদ এবং ৩৩ কেজি আদা উৎপাদন করেছে যা থেকে ২,০০০ টাকা খরচ করে ৬,০০০ টাকা লাভ হয়েছে। এই কার্যক্রম শুরুর আগে কৃষকেরা বছরে গড়ে ৪৭ কেজি ফল উৎপাদন করতো; যা বর্তমানে উন্নত জাতের ফল গাছ রোপণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ৯০ কেজি উৎপাদিত হয়েছে। এই কার্যক্রমের আওতায় কৃষকেরা তাদের বসতবাড়ির উচ্ছিষ্টাংশ দিয়ে কম্পোস্ট তৈরি করছে যা আগে করা হতো না। প্রতিটি বসতবাড়ি থেকে বছরে গড়ে ৫০ কেজি কম্পোস্ট উৎপাদিত হয়েছে যা কৃষকেরা বসতবাড়ির পাশে সবজি এবং আদা-হলুদ আবাদে ব্যবহার করেছে। এই কার্যক্রমের আওতায় সোনালী মুরগি পালন করা হচ্ছে; যা থেকে কৃষকেরা মাংস ও ডিম খাওয়ার পাশাপাশি বছরে গড়ে ৩,৫০০ টাকা খরচ করে ১৯,০০০ টাকা লাভ করেছে।
কবুতর পালনের আওতায় সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মাংস খাওয়ার পাশাপাশি বছরে গড়ে ৫০ টাকা খরচ করে ৭,০০০ টাকা লাভ হয়েছে। ছাগল পালনের মাধ্যমে বছরে গড়ে ২টি ছাগলের বাচ্চা উৎপাদিত হয়েছে। ছাগল পালনে বছরে গড়ে ৮০০ টাকা খরচ করে ছাগল বিক্রি করে ৭,০০০ টাকা আয় হয়েছে। কৃষকের ১০ শতাংশের অগভীর মজা পুকুরে সমন্বিত মাছ ও কচু চাষ করে বছরে গড়ে ১,৬০০ কেজি কচু এবং ৫০ কেজি লতি উৎপাদিত হয়েছে যা থেকে বছরে ৭,৫০০ টাকা খরচ করে ৪৮,০০০ টাকা লাভ হয়েছে। মিশ্র কার্প জাতীয় মাছ চাষ করে বছরে ৭,০০০ টাকা খরচ করে ১৫,০০০ টাকা লাভ হয়েছে। সর্বোপরি সমন্বিত মাছ ও কচু চাষ করে বছরে ১৪,৫০০ টাকা খরচ করে ৬৩,০০০ টাকা লাভ হয়েছে। রাইস ফার্মিং সিস্টেমস্ বিভাগের তত্তাবধানে পরিচালিত সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনার আওতায় কৃষকের বসতবাড়ির ১০ শতাংশ জমিতে সবজি ও আদা-হলুদ, ১০ শতাংশ অগভীর পুকুরে সমন্বিত মাছ-কচু চাষ এবং বসতবাড়ির আঙিনায় মুরগি, কবুতর এবং ছাগল পালনের মাধ্যমে বছরে ২৪,০০০ টাকা খরচ করে ১,১২,০০০ টাকা লাভ হয়েছে।
মতবিনিময় সভায় কৃষকরা বলেন, আমন ধান চাষ করার পর তিন মাস জমিগুলো পতিত থাকতো। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তাদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় ওই জমিগুলোতে সূর্যমুখী এবং সরিষা চাষ করা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হবে। কৃষক লিটন মন্ডল জানান, ফুল হচ্ছে মানুষের মনের খোরাক। তাই সূর্যমুখী এবং সরিষা চাষ করে আমরা ফসলের পাশাপাশি কৃষি পর্যটনের সুযোগ তৈরি করে বাড়তি আয় করছি ফুল দেখতে আসা দর্শনার্থীদের কাছে টিকেট বিক্রি করে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের রাইস ফার্মিং সিস্টেমস বিভাগ এগ্রফরেস্ট্রি গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় স্থানীয় জনগনের মাঝে বিভিন্ন জাতের গাছের চারা বিশেষ করে ফলদ গাছের চারা বিতরণ করেছে। এসব চারা বসতবাড়ির আঙ্গিনা ও তার চারপাশের ফাঁকা জায়গায় এবং ছোট বাগানে (Mini orchard) রোপণ করা হয়। বাড়ির নারীরা মূলতঃ এসব গাছের পরির্চচা করে থাকে। এসব বাগানের মাঝে আন্তঃফসল হিসেবে তারা মৌসুমি সবজি ও আদা-হলুদ মসলা আবাদ করে থাকে। এসব সবজি উৎপাদনের মাধ্যমে তারা পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত অংশ বিক্রি করে পরিবারের আয় বৃদ্ধিতে সাহয্য করে থাকে। কৃষকের ১০ শতাংশের ফল বাগানে আন্ত:ফসল হিসেবে বছরব্যাপী সবজি চাষ করে ফল উৎপাদনের পাশাপাশি বছরে গড়ে ১৩৮ কেজি সবজি এবং ৬০ কেজি আদা-হলুদ উৎপাদিত হয়েছে যা থেকে বছরে ২,৫০০ টাকা খরচ করে ৮,০০০ টাকা লাভ হয়েছে। এভাবে ব্রি’র রাইস ফার্মিং সিস্টেমস্ বিভাগ সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফার্মিং সিস্টেম সাইটের প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করে আসছে।