সাভার সংবাদদাতা: মহিষ সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে দেশীয় মহিষের জাত সংরক্ষণ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকল্পে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অর্থায়নে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধায়নে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট “মহিষ গবেষণা ও উন্নয়ন” শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়। প্রারম্ভিকভাবে প্রকল্পের সময়কাল নির্ধারণ করা হয় জুলাই’ ২০২০ হতে জুন’ ২০২৫ পর্যন্ত এবং প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয় ৬৩১৭.০০ লাখ টাকা। পরবর্তীতে প্রকল্পের মেয়াদকাল জুন’২০২৬ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয় এবং প্রাক্কলন ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৭২১১.০০ লাখ টাকা।
প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য উদ্দেশ্যসমূহ হলো- দেশি নদীর মহিষের দুধ উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য জাত উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ, দেশে উৎপাদিত সংকর (মুররাহ×দেশি) জাতের মহিষের প্রথম প্রজন্মের উৎপাদনশীলতা যাচাই এবং দ্বিতীয় প্রজন্মের বাচ্চা উৎপাদন; দেশীয় আবহাওয়ায় অভিযোজনের লক্ষ্যে বিশুদ্ধ মুররাহ জাতের মহিষের সিলেকটিভ ব্রিডিং কার্যক্রম গ্রহণ এবং প্রথম প্রজন্মের বাচ্চা উৎপাদন এবং লাভজনক মহিষ পালন ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের লক্ষ্যে নুন্যতম ৫টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও খামারী পর্যায়ে অভিযোজন।
এসব উদ্দেশ্য পূরণে প্রকল্পের বাস্তবায়নাধীন প্রধান প্রধান কার্যক্রমসমূহ হলো- দেশি নদীর মহিষের জাত উন্নয়ন গবেষণা; সিনথেটিক মহিষের জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে সংকরায়ন কার্যক্রম পরিচালনা; দেশে উৎপাদিত সংকর জাতের মহিষের উৎপাদনশীলতা যাচাই; বাণিজ্যিক খামারের জন্য মুররাহ জাতের মহিষের অভিযোজন; মহিষের খাদ্য ও পুষ্টি, রোগ নির্ণয়, বাসস্থান ব্যবস্থাপনা ও মহিষ হৃষ্টপুষ্টকরণ বিষয়ে ৫টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন; মহিষের দুধ থেকে ৩টি ভ্যালু এডেড পণ্য উদ্ভাবন ও বাজারজাতকরণ সংক্রান্ত এসওপি উদ্ভাবন; মহিষ সংক্রান্ত গবেষণার জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন (১৩টি মহিষের শেড, ৩টি গবেষণাগারের উর্ধ্বমূখী সম্প্রসারণ ও অন্যান্য নির্মাণ); গবেষণা ও খামার সরঞ্জামাদি ক্রয়; প্রজনন উপযোগী মুররাহ (৫০টি) এবং দেশি (৬৫টি) মহিষ ক্রয় এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন (পিএইচডি- ২টি; প্রশিক্ষণ-খামারি/উদ্যোক্তা-১৭৫০ জন, কর্মকর্তা-১০৪ জন, কর্মচারী-৬০ জন এবং বিজ্ঞানী-৫ জন।
বর্তমানে দেশের ৭টি বিভাগের ১২টি জেলায় প্রকল্পে কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৫৫.০৭% অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেছে এবং এর মধ্যে ৫১.৬৪% অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এই অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে বিএলআরআই এর প্রধান কার্যালয়ে মহিষ কোয়ারেন্টাইন শেড; প্রধান কার্যালয় এবং রাজশাহী আঞ্চলিক কেন্দ্রে গাভী, প্রজনন ষাঁড়, গ্রোয়িং মহিষ ও বাছুরের শেড; রাজশাহী আঞ্চলিক কেন্দ্রের অফিস কাম ল্যাব ভবনের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ; প্রধান কার্যালয়ে আরসিসি রোড, ইত্যাদি পূর্ত কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যেই ৬৫টি দেশি জাতের মহিষসহ গবেষণা ও খামারের বিভিন্ন সরঞ্জামাদি ক্রয় করা হয়েছে।
খামারি পর্যায়ে গবেষণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যেই ১১০০ জন খামারিকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে, ৮৬৮৭টি মহিষ নির্বাচন করা হয়েছে, ১৯৫৪১ ডোজ কৃমিনাশক ও ২৮০৬৬ ডোজ টিকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়াও, মহিষের রোগ-ব্যধি ও আন্তঃপ্রজনন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, দেশি ফডারের চাষ ও উচ্চ ফলনশীল ফডার চাষ ডেমোনেস্ট্রেশন, মহিষের ইস্ট্রাস-সিনক্রোনাইজেশন ও কৃত্রিম প্রজননন প্রযুক্তি ব্যবহার; গাভী মহিষের রেশন ফরমুলেশন, মহিষ হৃষ্টপুষ্টকরণ প্রযুক্তি, খামারের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মহিষের ক্ষুরা রোগ ও গলাফোলা রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি উন্নয়ন ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এছাড়াও, প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। গবেষণা কার্যক্রমসমূহের মধ্যে রয়েছে- সংকর জাতের মহিষের উৎপাদনশীলতা মূল্যায়ন; দেশি মহিষের জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন; প্রজনন সম্পৃক্ত জীব-প্রযুক্তি ব্যবহার পূর্বক দেশি মহিষের সংখ্যা বৃদ্ধিকরণ; মহিষের দুধে ফ্যাট এবং আমিষ উৎপাদনের সাথে সম্পৃক্ত মার্কার জিন সনাক্তকরণ; রোগ নির্ণয় প্রযুক্তি, কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি এবং রোগ নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি উদ্ভাবন; অধিক দুধ উৎপাদনক্ষম মহিষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন; নিরাপদ মহিষের মাংস উৎপাদনের জন্য মহিষ হৃষ্টপুষ্টকরণ মডেল উদ্ভাবন; মহিষের দুধ থেকে খাদ্যজাত পণ্য উদ্ভাবনের এসওপি এবং খামারি পর্যায়ে দুধের সংরক্ষণকাল বৃদ্ধির প্রযুক্তি উন্নয়ন; মহিষ খামারে পরিবেশ-বান্ধব ও উন্নত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে খামারের আয় বৃদ্ধি এবং খামারি পর্যায়ে মহিষ পালনের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন। এসব গবেষণা কার্যক্রমের আওতায় ইতোমধ্যেই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।
এসব গবেষণা কার্যক্রমের ফলাফল হিসেবে বেশ কিছু প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় উদ্ভাবনের অপেক্ষায় থাকা সম্ভাব্য প্রযুক্তিসমূহ হলো- মহিষ পালনে ফডারভিত্তিক স্বল্প খরচে খাদ্য ব্যবস্থাপনা; ২৪-২৬ মাস বয়সে বকনা মহিষের হিটে আসা; বাছুর মহিষ ব্যবস্থাপনা; মার্কার এসিস্টেড বুল সিলেকশন; মহিষের ইস্ট্রাস-সিনক্রোনাইজেশন প্রযুক্তি; মহিষের গলাফোলা রোগ নির্ণয়ের ডিভাইস উন্নয়ন; মহিষ খামারের বর্জ্য রিসাইক্লিং এবং দুগ্ধ পণ্যের ভ্যালুএডিশন (পনির, রসমালাই ও দই)। এসব প্রযুক্তির বেশির ভাগই বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে ভেলিডেশনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অবশিষ্ট প্রযুক্তিগুলোর ভেলিডেশন কার্যক্রমও অতিসত্বর শুরু করা হবে।
উল্লেখ্য যে, প্রকল্পের কিছু গবেষণা কার্যক্রম বিএলআরআই এর পাশাপাশি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ; গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর; পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল; সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ বাস্তবায়ন করছে।