শুক্রবার , মার্চ ৭ ২০২৫

গরু ও মাংসের বাজার: সংকট ও ভবিষ্যৎ করণীয়

নাহিনুর রহমান : গরু নিয়ে দেশে বড় রকমের মশকরা ঘটে গেছে গত হপ্তায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার  পর গত ৫৩ বছরে সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব কোন ব্রিড তৈরি,সংরক্ষণ ও জনমানুষের মতো ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারেনি; এর মাঝে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু মানুষ শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে নানান সময় দেশের বাইরে থেকে কিছু সিমেন অথবা জীবন্ত গরু এনে এক অদৃশ্য ও প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নেমেছে বহুবার।

গেল সপ্তাহে সরকারি প্রজনন খামার থেকে ব্রাহমা জাতের গরুকে নিলাম করে কসাইয়ের মাধ্যমে বিক্রির একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় যা পরবর্তীতে মহামান্য কোর্ট আদেশক্রমে স্তগিত রয়েছে, অথচ এই উন্নত প্রজাতির ষাড় গুলোকে দিয়ে উচিত ছিল প্রজনন এর সুযোগ তৈরি করা ও এই জাত পালনে আগ্রহীদের কাছে এটি পোওছে দেয়া, অথচ সেটা না করে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এই উন্নত পিডিগ্রীর (আমদানি কারকের দাবি অনুযায়ী)ষাড় গুলোকে গত তিন বছরে নস্ট করা হয়েছে নানা আইনি জটিলতা ও লাল ফিতার দৌরাত্ন্যে।

বাংলাদেশের সরকারি খামারগুলোতে প্রতিবছর যে পরিমাণ গরু বাতিল অথবা প্রজননের যোগ্য না থাকার কারণে বিক্রি করার উদ্যোগ নেয়া হয় এর মাঝেও এক বিশাল শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে বলে নানা কানাঘোষা শোনা যায়। অথচ প্রতিবছর রোজার সময় সরকারি খামারের কালিং যোগ্য গরুগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র এর মাধ্যমে বিক্রি করলে মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি লাভ করত, যদিও সারা দিনে প্রতিদিন ৮০০০-১০০০ গরুর তুলনায় এই সংখ্য অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।

বাংলাদেশের মিলিটারি ফার্ম গুলোতে বিশাল সুবিধা সহ চারন ভূমি ও সরকারি সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এর পরিপূর্ণ ব্যবহার কখনোই করা হয়নি,সৈনিকদের প্রতিদিনের আমিষের চাহিদা পূরণে সারাদেশেই মিলিটারি ফার্ম থেকে গরু সাপ্লাই করার পরেও ঘাটতি থাকার দরুন সিএসডি’র মাধ্যমে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে মাংস ক্রয় করা হয় অথচ এখানে বিশাল সুবিধা সম্বলিত মিলিটারি ফার্মগুলোতে মাংসগুলো উৎপাদনের প্রজেক্ট নেয়া সম্ভব ছিল অনেক আগে থেকেই।

এবার আসুন আমরা ফিরে যাই আমাদের গরুর বাজারে মাংসের দাম কমার সেই আশার বাণীতে, প্রতিবছর যখন কুরবানী এগিয়ে আসতে থাকে ঠিক তার আগ মুহূর্ত থেকে অন্যতম প্রধান উপাদান গমের ভুষি, ভুট্টা ও রাইস ব্রান এর দাম হু হু করে বাড়তে থাকে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এই খাদ্য আমদানির সাথে যারা জড়িত তারা কমবেশি কোন না কোন ভাবে গরু পালনের সাথে জড়িত কিন্তু বাজারে বিশাল এক অচেনা সিন্ডিকেটের হাতে দেশের প্রান্তিক খামারিরা জিম্মি, এর প্রথমত কারণ খামারিদের স্বার্থ রক্ষা ও এসব নিয়ে কথা বলার কোন শক্তিশালী অ্যাসোসিয়েশন বা বডি এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনাই; যদিও বা মাঝে মাঝে কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে কিন্তু তারাও নিজস্ব সিন্ডিকেট ও নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত থাকেন অথচ উচিৎ  ছিল সারাদেশে সমবায়ের মাধ্যমে ছোট ছোট খামারীদের একত্র করে গরুর মাংস ও দুধের একটি কার্যকর সাপ্লাই চেইন তৈরি করা।

দুর্ভাগ্য যে এত বছর পরেও দালালদের দৌরাত্ব ও মধ্য সত্ত্বভোগীদের কারণে প্রান্তিক খামারীরা কখনোই ন্যায্য মূল্য পেয়ে উঠেন না,বছরব্যাপী যদি ডাটা কালেকশন করা হয় দেখা যাবে যে উত্তরবঙ্গের সর্বশেষ জেলাতে মাংসের মূল্য যদি হয় ৬০০ টাকা কেজি ঢাকায় তখন মাংস ৭৫০ টাকা এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ৮০০ টাকা বা তার বেশি।

তাহলে বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ১ কেজি মাংসের পার্থক্য ১৫০-২০০ টাকা কখনো কি স্বাভাবিক প্রশ্ন রেখে গেলাম?

গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ অসং্খ্য খামারি তৈরি হয়েছেন যার অধিকাংশই ছিলেন মোটাতাজাকরণ খামারি যারা বাজার থেকে গরু কিনে নির্দিষ্ট সময় ধরে সেটিকে মোটাতাজা করে বাজার বিক্রি করেন;১৫ বছরের যে পরিমাণ খামারি তৈরি হয়েছে তার মাঝে অর্ধেকের বেশি ঝড়েও গেছে কারণ উৎপাদন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অন্যের উপর নির্ভর হয়ে কখনোই সাপ্লাইচেন কে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে টিকিয়ে রাখা যায় না।

অথচ এইদেশে ডেইরি খামারির সংখ্যা ততটা বেড়ে ওঠেনি, যার ফলে মাংসের গরুর জন্য চাতক পাখির মত পার্শ্ববর্তী দেশ গুলোর সীমান্তে তাকিয়ে থাকা বাদে কোন উপায় নেই অথচ আমাদের দেশে অধিকাংশ ডেইরিতে পালিত ফ্রিজিয়ান ষাঁড় গরু আড়াই থেকে তিন বছর বয়সে হর হামেশাই ৭০০ থেকে ৯০০ কেজিওজন হয়ে থাকে।

তাহলে বিশাল খামারি গোষ্ঠী তারা কেন বিজ্ঞানসম্মত উপায় ও নিরাপদ মাংস উৎপাদনে এগিয়ে আসছেন না এই কারণে কেচো অনুসন্ধান করতে গেলে দেখা যাবে প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তর খামারি উন্নয়নে গত সাত বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিলেও;সেগুলোতে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, দলবাজি,  রেষারেষি ও ব্যক্তি স্বার্থ প্রাধান্য দেওয়ার কারণে অনেক প্রকল্প অর্থ ব্যয় করেও আলোর মুখ দেখতে পারেনি।

এই দেশে লম্বা সময় ধরে চলমান একটি প্রকল্প হচ্ছে কৃত্রিম প্রজনন ও জাত উন্নয়ন অথচ সারাদেশে থাকা প্রায় ৫ হাজার ইউনিয়ন কৃত্রিম প্রজনন কর্মী স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে কাজ করেন ও নামমাত্র একটি ভাতা লাভ করেন,যা এই যুগে সংসার চালানোর মতো দূরে থাক পুরো মাসের যাতায়াত খরচ তোলা সম্ভব হয় না।

হাস্যকর ও বেদনাদায়ক হলেও সত্য এইযে স্বেচ্ছাসেবীরা প্রজনন ও  জেনেটিক্সের সামান্যতম আপডেট নলেজ না রেখেই দিনের পর দিন কৃত্রিম প্রজনন করে যাচ্ছেন,রিপিট ব্রিডিং আর ইনব্রিডিং এর ফলশ্রুতিতে গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশের নিজস্ব দুধ মাংসের জাত তৈরি হয়নি।

ঘাস উৎপাদন বা ফডার আপগ্রেডেশনে সরকার প্রকল্প হাতে নিলেও মানুষ এখনো সেই ২০ বছর আগে নেপিয়ার আর পাকচুং এর কাটিং এর মাঝে পড়ে আছে অথচ প্রয়োজন ছিল টিস্যু কালচারের মাধ্যমে এই কাটিং কে আর উন্নত করে সারা দেশে সহজলভ্য ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া। ভুট্টা চাষে গত ৮ বছরে এক নিরব বিপ্লব ঘটে গেল যা সরাসরি জিডিপিতে ভুমিকা রাখছে ও এটা নিয়ে টানা ৩ বছর সারা দেশ আমি চষে বেড়িয়েছি কিন্ত এখন পর্যন্ত ফডারের জন্য শক্তিশালী কোন ভুট্টার বীজ খামারীদের জন্য সহজলভ্য নয়। এমনকি সাইলেজ উৎপাদনের জন্য মেশিনারিজ ও প্যাকেজিং মেটেরিয়াল এর উপর রয়েছে বড় আকারের ডিউটির চাপ অথচ একটি উন্নত জাতি গড়ার জন্য প্রোটিনের কোন বিকল্প নেই।

এটা তো অস্বীকার করে উপায় নেই যে প্রোটিনের সোর্স হিসাবে মাছ ও মুরগির উৎপাদনে এই দেশের ব্যবসায়ীরা বড় ভূমিকা রাখছেন, তাদের শক্তিশালী এসোশিয়েশন ও রিসার্চ উইং আছে আর এই ব্যবসাতে থাকা অধিকাংশ উদ্যোক্তাই এই ব্যাকগ্রাউন্ড এর, তাদের প্রচেষ্টা সরুপ এখনো ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে ১ কেজি ব্রয়লার ও ১০ থেকে ১২ টাকায় একটি ডিম মানুষ খেতে পারছে।

কিন্তু মেধা গঠন ও শক্তিশালী জাতি গঠনে গরুর দুধ ও মাংস এর অবদান অনস্বীকার্য তাই খামারি ও সরকারের প্রতি আকুল আবেদন আপনারা অন্ততপক্ষে নিচের কাজগুলো করুন:

১. একটি কার্যকরী ডেইরি বোর্ড গঠন করুন।

২. দেশের প্রজনন নীতিমালা আধুনিক ও যুগ উপযোগী করে কঠোরভাবে মেনে চলার সুযোগ তৈরি করুন।

৩. গো-খাদ্যের উপর ডিউটি হ্রাস করে ও উন্নত জাতের ঘাসের জাত ও বীজ সহজলভ্য করুন।=

৪. দুধ ও মাংসের বাস্তবিক ন্যায্য দাম সারা দেশের জন্য ঠিক করে দিন মাছ এবং মুরগির মাংসের মত ওজন হিসাবে জীবন্ত গরু বিক্রির ব্যবস্থা করুন।

প্রয়োজনে আইন করুন বড় মাছের ক্ষেত্রে যেমন যত ওজন হয় দাম তত বাড়তে থাকে গরুর ক্ষেত্রেও একটি নায্য দাম নীতিমালা সহ ঠিক করে দেয়া হোক।

আমরা যেন সেই দিন আর না দেখতে হয় একটি গরু কোরবানিতে বিক্রি হবে তার দাম এক কোটি টাকা! জেনেটিক ভ্যালু বা বংশীয় মর্যাদা হিসাবে একটি গরুর মূল্য ১০ কোটি টাকাও হতে পারে যখন সেটি প্রজনন এর কাজে ব্যবহার করা হবে।

সারাদেশে ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টের আন্ডারে তৈরি হওয়া মিল্ক ভ্যালু চেইন, কসাইখানা, ঘাসের মাঠ এবং সাইলেজ উদ্যোক্তাদের আরো বিজ্ঞানসম্মত ও সঠিকভাবে পরিবেশ তৈরি করুন। এই দেশে একজন শ্রমজীবী মানুষ সপ্তাহে চার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা আয় করেন।

সেখান থেকে তাকে পরিবার, পুষ্টিকর খাবার,চিকিৎসা, বাসস্থান, বস্ত্র সবই জোগাড় করতে হয়।তাই মাসে অন্তত ৩ কেজি মাংস খেতে হলে বর্তমান বাজারে ২৫০০ টাকার বেশি খরচ করতে হবে;যেখানে তার মাসে আয় ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা।

 তাই অন্তত এই জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করে হলেও মাংসের কেজি ৫০০ থেকে ৬৫০ টাকার ভেতরে সারা বছর থাকা উচিত।

প্রয়োজনে দেশে বাইরের থেকে উন্নত প্রজাতির জীবন্ত গরু আমদানি করে শুধুমাত্র জবাই করে মাংস হিসবে বিক্রি করার অনুমতি প্রদান করে উদ্যোক্তাদের ব্যবসার পথ সুগম করে দিন তাতে করে উদ্যোক্তা তৈরি হবে এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাংস খাবার সুযোগ সৃষ্টি হবে।

সেই সাথে গরুর চামড়ার যে ঐতিহ্য ছিল সেই ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে চামড়ার ন্যায্য মূল্য ট্যানারি পল্লীতে ইটিপি এর সঠিক ব্যবহার, পরিবেশ ও বায়ু দূষণ রোধ করে ওয়েট ব্লু চামড়া অধিক পরিমাণে রপ্তানির ব্যবস্থা করা হোক, তাতে করে ডলারের ভারসাম্য রক্ষা হবে এবং দেশে যথেষ্ট কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে

পরিশেষে বলবো এই দেশে মানুষকে ন্যায্য মূল্যে মাংস খাওয়াতে সরকার,প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, সরকারি প্রতিষ্ঠান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও খামারিদের একত্র হয়ে ভোক্তাদের জন্য কাজ করতেই হবে কারণ এই এক ছাতার নিচে আসা সকালেই ভোক্তা, সবাই হয়তো উতপাদক নন, তাই আসুন অন্তত দেশের মানুষের স্বার্থে আমরা সবাই মিলে এই কাজটা করার শপথ নিই।

লেখক : অনুজীববিজ্ঞানী, খামারী ও সাইলেজ উৎপাদক।

This post has already been read 43 times!

Check Also

ওয়াপসা (WPSA) এবং বিশ্বব্যাপী পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়নে শতবর্ষের অবদান!

মো. খোরশেদ আলম জুয়েল : বিশ্বব্যাপী পোল্ট্রি বিজ্ঞান ও গবেষণার উন্নয়নে এক শতাব্দীরও বেশি সময় …